বিনিয়োগে স্থবিরতা: অর্থনীতির গতি ফেরাতে দরকার আস্থা ও নীতিগত স্থিতিশীলতা

দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরেই স্থবির। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ—যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অথচ একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার এ ব্যর্থতা দেশের অর্থনীতিতে গভীর সংকেত বহন করছে।

বিনিয়োগ স্থবিরতার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারেও। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত উৎপাদন খাতের ২০০ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১২টি কোম্পানি গত এক বছরে সম্প্রসারণে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষিত মোট বিনিয়োগের অঙ্ক প্রায় ২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা—যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন। বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, এত কমসংখ্যক কোম্পানির কাছ থেকে বিনিয়োগ ঘোষণার নজির নেই।

স্থবিরতার নেপথ্যের কারণ

বিনিয়োগে ভাটার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি: সুদহার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কমেছে।

নীতিগত অনিশ্চয়তা: হঠাৎ কর ছাড় বা প্রণোদনা প্রত্যাহার ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।

ভোগ ব্যয়ের হ্রাস: মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমেছে, নগদ প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে।

আমদানি সংকোচন: নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে না ওঠায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ২৫% কমেছে, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানিও হ্রাস পেয়েছে।

ফলে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানি আয় প্রত্যাশিত গতিতে বাড়ছে না।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য

এমজেএল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন,
“বিদেশগামী অয়েল ও গ্যাস ক্যারিয়ার খাতে বিনিয়োগে সরকারের কর-ভ্যাট ছাড় ছিল বড় প্রণোদনা। এ সুবিধা হঠাৎ প্রত্যাহার করায় খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী বলেন,
“অর্থনীতি সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় নগদ প্রবাহ কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই এ পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ করা কঠিন।”

সম্ভাবনা কোথায়?

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বিনিয়োগ খরা কাটাতে জরুরি তিনটি পদক্ষেপ প্রয়োজন—

সুদহার নিয়ন্ত্রণ ও সহজ ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা

নীতিগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখা—কর ও প্রণোদনা নীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন না আনা

ভোগ ব্যয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া—কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের আয় বাড়ানো

অন্যদিকে ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার কিছুটা স্থিতিশীল, ডলার সংকট তুলনামূলক কম এবং বিনিময় হারও স্থির অবস্থায় আছে। অনেক ব্যবসায়ী নির্বাচনের পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী।বিনিয়োগ অর্থনীতির প্রাণশক্তি ,নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান বাড়ে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়, অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। কিন্তু বিনিয়োগে ভাটা পড়লে অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে যায়। তাই সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং দীর্ঘমেয়াদে একটি স্থিতিশীল, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।

Share This News