অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনকে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত করতে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে। এতে মজুতদারি, ভেজাল, অতিরিক্ত দাম নেওয়া এবং ই-কমার্স প্রতারণার মতো অপরাধে নতুন করে কঠোর শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে এখনো কাঠামোগত ঘাটতি রয়ে গেছে।
মজুতদারির বিরুদ্ধে শাস্তি
খসড়া অনুযায়ী, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে নিত্যপণ্য মজুত করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। বর্তমান আইনে মজুতদারির জন্য আলাদা কোনো শাস্তির ধারা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ভোক্তা সংগঠনগুলো সমালোচনা করে আসছিল।
ভেজাল ও নিরাপত্তা মান অমান্য
খসড়ায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা মান অমান্য করে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আমদানি বা বিক্রি করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এ সীমা আগে ছিল ১ লাখ টাকা। তবে ভেজাল পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করা হয়েছে।
ই-কমার্স প্রতারণা আইনের আওতায়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ই-কমার্স খাতে পণ্য না দেওয়া বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের মতো প্রতারণা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন খসড়ায় অনলাইনে প্রতারণার বিরুদ্ধে আলাদা ধারা যোগ করা হয়েছে, ফলে ই-কমার্স ব্যবসায় প্রতারণাও এখন ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় আসবে।
জরিমানা ও আপিল ব্যবস্থার পরিবর্তন
মিথ্যা বা হয়রানিমূলক অভিযোগ দায়েরের সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর থেকে কমিয়ে এক বছর করা হয়েছে। তবে জরিমানা ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা আগে আইনে ছিল না।
বিশেষজ্ঞ ও সংগঠনের মতামত
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলিম আকতার খান বলেন, “আইনের খসড়ায় দীর্ঘদিনের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে এবং ডিজিটাল বাণিজ্যকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।”
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। তবে শুধু জরিমানা বাড়ালেই হবে না, অধিদপ্তরকে বাস্তবিক অর্থে শক্তিশালী করতে হবে।”
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “ডিজিটাল বাণিজ্য অন্তর্ভুক্তি ইতিবাচক হলেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আরও বৃহত্তর সংস্কার প্রয়োজন। অন্যান্য দেশে ভোক্তার সংজ্ঞা বিস্তৃত। বাংলাদেশেও সেই দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি।”
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আলাদা বোর্ড ও কাউন্সিল রয়েছে, যা সংসদের কাছে জবাবদিহি করে স্বাধীনভাবে কাজ করে। অথচ বাংলাদেশে কার্যক্রম এখনো আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চূড়ান্ত প্রক্রিয়া
চলতি বছরের ২৭ মার্চ গঠিত ৯ সদস্যের কমিটি খসড়াটি পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। আইনজীবী, ব্যবসায়ী সংগঠন ও ভোক্তা সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ কমিটিতে আছেন। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এটি অধ্যাদেশ আকারে পাস হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সংশোধনী যুগোপযোগী হলেও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োগ কাঠামো শক্তিশালী করা, ভোক্তার সংজ্ঞা বিস্তৃত করা এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অনুসরণ করা জরুরি।