বাংলাদেশের শ্রমবাজার গত একবছরে এমনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত কর্মসংস্থান-সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি বাস্তবে খুব সীমিত ফল দিয়েছে। BBS-এর ত্রৈমাসিক এবং Labour Force Survey অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর কোয়ার্টারে বেকারত্ব হার ৪.৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭.৩ লাখ। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১.৭ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুব ও শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবক-যুবতীদের মধ্যে প্রায় ১.৯৪ মিলিয়ন বেকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্ব হার ১৩.৫৪ শতাংশ। শিক্ষিত বেকারত্বের এই উচ্চ হার, শুধুমাত্র শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা যথেষ্ট নয়, বাজার-উপযোগী দক্ষতার অভাব এবং চাকরির সুযোগের সীমাবদ্ধতা সমস্যাকে জটিল করে তুলছে।
মোট শ্রমবাজার হ্রাস পেয়েছে, বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ কমার কারণে মোট কর্মসংখ্যা সংকুচিত হয়েছে, যা অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতার হ্রাস এবং আয়ের অসমতা বাড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ছাড়া স্থায়ী কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমিত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গুণগত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা দেখা গেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় ৮০% শ্রমিক ইনফরমাল খাতে নিযুক্ত, যেখানে কাজ স্থায়ী নয়, সামাজিক সুরক্ষা নেই এবং আয় সীমিত। এর ফলে ঘোষিত চাকরি-সৃষ্টি প্রকল্পগুলোর বাস্তব প্রভাব সীমিত হয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাধা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ধীরগতি, ঋণের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা নতুন শিল্প এবং বড় পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই কারণে সরকারি ঘোষিত কর্মসংস্থান প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে মোট ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বড় অংশ বরাদ্দ হয়েছে। এই অর্থায়ন সময়সাপেক্ষ এবং তাৎক্ষণিকভাবে বেকারত্ব হ্রাসে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন “Skills for Employment Investment Program (SEIP)” এবং অন্যান্য প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৪১,০০০ যুবকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চ্যালেঞ্জ যেমন প্রশিক্ষণের মান, কাজের গুণগত মান, এবং ইনফরমাল থেকে ফর্মাল খাতে রূপান্তর কার্যকর না হলে প্রকল্পগুলোর প্রভাব সীমিত থাকবে।
গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আগামী গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য এই পরিস্থিতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেকারত্বের এই উর্ধ্বগতি এবং শ্রমবাজার সংকোচন নতুন সরকারের জন্য নীতি এবং বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় বড় চাপ তৈরি করবে। তারা যদি যুব ও শিক্ষিত বেকারদের জন্য কার্যকর প্রশিক্ষণ, স্কিল-ম্যাচ, নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পদক্ষেপ এবং MSME ও প্রাইভেট খাতকে উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়তে পারে।
সর্বপরি, পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতি, যুব ও শিক্ষিত বেকারত্বের বৃদ্ধি, ইনফরমাল খাতের প্রাধান্য এবং নারীর শ্রমবাহিরতার হ্রাস আগামী গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, বাস্তবায়ন ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। জনগণ আশা করছে যে নতুন সরকার শুধু ঘোষণাই নয়, বাস্তব কর্মসূচি চালু করে গুণগত চাকরি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
লেখক: কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক