আরামের প্রলোভনে মৃত্যুফাঁদ: সড়কে ছুটছে অবৈধ স্লিপার বাস

গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনাটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. বাহাউদ্দিন আল ইমরানের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার পথে সেন্টমার্টিন পরিবহনের দ্বিতল স্লিপার বাসটি (ঢাকা মেট্রো-ব-১২-২৮৮১) কুমিল্লার কাছাকাছি পৌঁছে মধ্যরাতে হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। প্রাণহানি না ঘটলেও গুরুতর আহত হন অনেক যাত্রী।

“বাসটি যাত্রার শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণহীন মনে হচ্ছিল। একটু গতি উঠলেই হেলেদুলে চলছিল। যাত্রীরা অনেকবার ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি,” জানান আইনজীবী ইমরান “।

এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে রাতের আঁধারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এমন অবৈধ স্লিপার বাস। আরামদায়ক যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রী টানলেও এসব বাসের বেশির ভাগই অনুমোদনবিহীনভাবে চলছে। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির আশঙ্কা।

‘মারণফাঁদে’ পরিণত হয়েছে বাসগুলো

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্লিপার বাসগুলো আসলে আরামের আড়ালে মারণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এসব বাসে নিরাপত্তা নকশা, ভারসাম্য বণ্টন, ব্রেক সিস্টেম এবং জরুরি নির্গমন পথের কোনো বৈজ্ঞানিক হিসাব রাখা হয় না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের বের হওয়ার উপায় থাকে না। আগুন লাগলে বা বাস উল্টে গেলে উদ্ধার কাজও হয়ে পড়ে কঠিন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাধারণ এক তলা বাসের চেসিসের ওপরই তৈরি হচ্ছে দ্বিতল স্লিপার বাস। কোনো কোনো বাসের নিচ তলায় বিজনেস ক্লাস সিট ও ওপরে স্লিপার সিট থাকে, আবার কোনোটিতে দুই তলাতেই স্লিপার সিট। বাসগুলো সাধারণ বাসের তুলনায় অনেক বেশি উচ্চতার তৈরি করা হয়।

কীভাবে পাচ্ছে অনুমোদন?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা জানান, টাইপ অনুমোদন না থাকায় বর্তমানে স্লিপার বাস অনুমোদনের সুযোগ বিআরটিএর নেই। তবে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।

“প্রথমে সাধারণ বাসের অনুমোদন নিয়ে পরবর্তীতে বাসগুলোকে রূপান্তর করে স্লিপার বাসে পরিণত করা হয়,” জানান তিনি। তবে বছর ঘুরে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে আসলে সেসব বাস কীভাবে ফিটনেস সনদ পায়, এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।

বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, দুর্ঘটনার কবলে পড়া সেন্টমার্টিনের স্লিপার বাসটিও মূলত একটি ৪০ সিটবিশিষ্ট সাধারণ বাসের নিবন্ধন পেয়েছে। পরে রূপান্তরিত হয়েছে বিলাসবহুল স্লিপার বাসে। ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর রেজিস্ট্রেশন পাওয়া বাসটির ফিটনেস নবায়নও হয়েছে গত বছর ৯ ডিসেম্বর।

দুর্ঘটনার শিকার অ্যাডভোকেট বাহাউদ্দিন আল ইমরান সম্প্রতি বিআরটিএ, বাসটির মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের একটি লিগ্যাল নোটিস দিয়েছেন। সেখানে অবৈধ বাস চলাচল রোধের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও চেয়েছেন তিনি।

অব্যাহত রয়েছে অভিযান

অবৈধ স্লিপার বাসের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “অনুমোদনহীন অর্থাৎ অবৈধ বাসের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম দিকে ২১টি স্লিপার বাসের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। অনুমোদনহীন একটি বাসও সড়কে চলাচল করতে পারবে না।”

তদারকিতে দুর্বলতা

বুয়েটের সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, “বিআরটিএ তো আসলে রেগুলেটরি বডি, তারাই রেগুলেশন করবে। তাহলে বিআরটির অনুমোদন ছাড়া বাস চলছে মানে বিআরটিএর অবশ্যই তদারকির দুর্বলতা রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্কশপে দোতলা বাসের বডি সেটআপ করছে। চেসিস আমদানির ক্ষেত্রেও বিআরটিএ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়।”

আজ জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস

এদিকে আজ ২২ অক্টোবর প্রতি বছরের মতো এবারও সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’।

দিবসটি উপলক্ষে হাতিরঝিল থেকে সড়ক ভবন পর্যন্ত শোভাযাত্রা ও র‌্যালি হবে। একই সঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে ১৬ জন পেশাদার দক্ষ চালককে পুরস্কার দেবে বিআরটিএ।

নিরাপদ সড়ক দিবসে অবৈধ স্লিপার বাসের মতো মরণফাঁদ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে।