নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন- আগামী প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি


সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA) Philip Morris Bangladesh Limited কে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে (Plot-41, Jhengiakhola, Kamargram, Sonargaon) একটি নিকোটিন পাউচ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশে নেশাজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য নতুন শিল্প স্থাপনে এই অনুমোদন দেওয়ার ফলে জনস্বাস্থ্যে এক ভয়াবহ সংকটে পড়ব
এই প্রকল্পের আনুমানিক বিনিয়োগ ৫.৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে কোম্পানিটি নিজেকে Manufacturing, Importer, Supplier এবং Exporter হিসেবে নিবন্ধিত করেছে। অনুমোদনপত্র অনুযায়ী, তাদের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৫৩৬.৩ ইউনিট নিকোটিন পাউচ, যেখানে ৬৩ জন কর্মী থাকবে, যার মধ্যে ৩ জন বিদেশি নাগরিক। প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মূল্য নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ১.৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিদেশ থেকে আমদানির অনুমোদন পেয়েছে।
এই অনুমোদন দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও জনস্বাস্থ্য নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কারণ, নিকোটিন পাউচ একটি অত্যন্ত আসক্তিকর পণ্য, যা মুখের ভেতরে রেখে ব্যবহৃত হয় এবং এর নিকোটিনের ঘনত্ব সাধারণ সিগারেটের তুলনায় বহুগুণ বেশি। একটি সিগারেটে সাধারণত ১ থেকে ২ মিলিগ্রাম নিকোটিন থাকে, কিন্তু নিকোটিন পাউচে সেই মাত্রা প্রায় ১২ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। এটি দ্রুত শরীরে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে আসক্তি তৈরি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক ও অন্যান্য জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই নীতির আলোকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল ধূমপান ও তামাকজাত পণ্যের বিকল্প নেশাজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। কিন্তু একদিকে সরকার যখন তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে, তখন অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দিয়ে একটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানিকে নতুন নেশাজাত পণ্য উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া- এক ধরনের নীতিগত দ্বৈততা ও আত্মবিরোধী পদক্ষেপ।
এমন একটি প্রকল্প অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC) এর শর্ত লঙ্ঘন করছে, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে নতুন নিকোটিন বা তামাকজাত পণ্য বাজারে প্রবেশে বাধা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নীতিমালা অনুসারে সরকারগুলোর উচিত ছিল এমন প্রকল্পের অনুমোদন স্থগিত করা এবং জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, অনুমোদনপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রকল্পটি “১০০% দেশীয় বাজারমুখী (Domestic Oriented)।” অর্থাৎ উৎপাদিত সব নিকোটিন পাউচ দেশের অভ্যন্তরেই বিক্রি হবে, যা সরাসরি তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে বিপণন কৌশল বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ২০ শতাংশ কিশোর কোনো না কোনোভাবে তামাক বা নিকোটিন আসক্তিতে ভুগছে। নতুন এই পণ্য বাজারে এলে আসক্তির পরিসর আরও বিস্তৃত হবে, বিশেষত তরুণ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
অর্থনৈতিক বিনিয়োগের নামে এমন একটি নেশাজাত পণ্য উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া মানে ভবিষ্যতের কর্মক্ষম প্রজন্মকে বিপন্ন করা। দেশের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে- বিনিয়োগের প্রকৃত অর্থ তখনই ইতিবাচক হয়, যখন তা মানুষের স্বাস্থ্য, জীবনমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।
জনস্বাস্থ্যই জাতীয় সম্পদ। নিকোটিনভিত্তিক নতুন পণ্য উৎপাদন বন্ধ করা শুধু জনস্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয় নয়; এটি নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় আনা জরুরি এবং প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান, যাতে বাংলাদেশ সত্যিকারের তামাকমুক্ত ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হতে পারে। আমরা কোনো বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার বিনিময়ে নিজের প্রজন্মকে উৎসর্গ না করি।

সূত্র-কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক
সদস্য
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫
বাস্তবায়নে গঠিত বিভাগীয় টাস্কফোর্স কমিটি, খুলনা