”বুকের দুধ বিকল্প আইন লঙ্ঘন: বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্যের উপর ফর্মুলা দুধ বিপণনের শোষণ”

কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক

বাংলাদেশে বুকের দুধের বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা বা গুঁড়ো দুধের ব্যবহার ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে চলেছে, যা শিশুস্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফ দীর্ঘদিন ধরে জন্মের পর অন্তত ছয় মাস পর্যন্ত একচেটিয়াভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু দেশের বাস্তবতায় গুঁড়ো দুধ কোম্পানি ও বিপণন সংস্থাগুলোর আক্রমণাত্মক প্রচারণা সেই স্বাস্থ্যনীতি ও ২০১৩ সালের “বুকের দুধ বিকল্প (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন”-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটাচ্ছে।

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় মাত্র ১৫ শতাংশ মা একচেটিয়াভাবে বুকের দুধ খাওয়ান। প্রায় ৬০ শতাংশ মা বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য তরল খাদ্য দেন এবং ২৫ শতাংশ মা সম্পূর্ণভাবে ফর্মুলা দুধের উপর নির্ভরশীল। এমনকি অনেক মা শিশুর ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই সুজি, কলা বা তরল খাবার খাওয়ানো শুরু করেন, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পরিপাকতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। ফর্মুলা দুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন উপহার, ছাড় এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করে আইন অমান্য করেই বিপণন চালিয়ে যাচ্ছে। WHO ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এসব কোম্পানি বিশেষভাবে ৫২ শতাংশ বাবা-মা ও গর্ভবতী মায়েদের লক্ষ্য করে তাদের প্রচারণা পরিচালনা করছে।

শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বুকের দুধে প্রায় দুই শতাধিক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বুকের দুধ শুধু শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় না, বরং মায়ের স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। অপর্যাপ্ত স্তন্যপান অনুশীলনের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ শিশু মারা যায় এবং এক লাখেরও বেশি মা স্তন্যপানজনিত জটিলতায় ভোগেন। এ ছাড়া, অপর্যাপ্ত স্তন্যপানের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিবছর প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে কর্মজীবী মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সহায়ক কর্মপরিবেশের অভাবও বুকের দুধ খাওয়ানোর অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক হলেও, অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখনো চার মাসের বেশি ছুটি দেয় না। ফলে, মায়েরা কাজে যোগদানের পর বাধ্য হয়ে ফর্মুলা দুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, সামাজিক চাপ, শিশুর পুষ্টি বা ওজন নিয়ে উদ্বেগ, এবং বাজারজাত প্রচারণার প্রভাবে অনেক মা ফর্মুলা দুধকে আধুনিক বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করেন। এই প্রবণতাকে উৎসাহিত করতে গুঁড়ো দুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে উপহার, স্পনসরশিপ ও আর্থিক সুবিধা প্রদান করে থাকে, যা আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্বাস্থ্যকর্মী ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য। বুকের দুধ বিকল্প আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, পর্যাপ্ত বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিতকরণ, কর্মজীবী মায়েদের জন্য স্তন্যপান সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ফর্মুলা দুধ বিপণনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ফর্মুলা কোম্পানির আর্থিক বা প্রচারণামূলক পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি- এসব উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে ফর্মুলা দুধ বিপণনের শোষণ ও বুকের দুধ বিকল্প আইন লঙ্ঘন এখন শিশুস্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব বিপদে পরিণত হয়েছে। মায়ের দুধের অমূল্য গুণাগুণ ও শিশুর ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি, আইন প্রয়োগে কঠোরতা, এবং কর্মজীবী মায়েদের বাস্তব সহায়তা প্রদান ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই। শিশুর প্রথম ছয় মাসের স্তন্যপান শুধু পুষ্টির প্রশ্ন নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যতের ভিত্তি। তাই মায়ের বুকের দুধ রক্ষা ও প্রচার আজ সময়ের সবচেয়ে জরুরি দাবি।