দেশের অর্থনীতিতে নতুন আশঙ্কার সংকেত দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি একের পর এক কমতে থাকায় গত আগস্ট মাসে তা নেমে এসেছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এটি গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি। ২০০৩ সালের পর এমন পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান শুধু একটি সংখ্যা নয়, বরং দেশের বেসরকারি খাতে যে গভীর স্থবিরতা নেমে এসেছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, চলমান অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার চেয়ে সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগকেই নিরাপদ মনে করছে।
প্রতি মাসেই কমছে প্রবৃদ্ধি
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে ধারাবাহিক পতন শুরু হয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যেখানে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, সেখানে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে তা প্রায় অর্ধেক কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে।
মাস অনুসারে হিসাব দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। জুন মাস শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ, জুলাইয়ে সামান্য বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, কিন্তু আগস্টে আবারও কমে যায়। এই ক্রমাগত পতন বেসরকারি খাতের যে নাজুক অবস্থা তা স্পষ্ট করে তুলছে।
কেন থমকে গেল বিনিয়োগ?
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসরকারি খাতে এই স্থবিরতার পেছনে রয়েছে বহুমুখী কারণ। সবচেয়ে বড় কারণ হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর থেকে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পড়েছেন। অনেকে তাদের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতির চাপে অনেক চালু কারখানাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক ঋণের চড়া সুদহার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ব্যাংকের ঋণের সুদহার বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে। এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন বিনিয়োগ করা অনেক উদ্যোক্তার জন্যই লাভজনক নয়। তাই তারা ঋণ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, চড়া সুদহারের কারণে আগে থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করাও অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠান আগে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করত, তাদের কারও কারও ঋণও এখন খেলাপি ঋণের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও জটিল করছে পরিস্থিতি
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ব্যাংকিং খাতেও নেমে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা এখন হয় সীমিত হয়ে পড়েছে, নয়তো একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার পর্ষদ পরিবর্তন হওয়া ১৪টি ব্যাংকের বেশ কয়েকটির ঋণ বিতরণ কার্যক্রম এখন সীমিত বা বন্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক আর্থিক সংকটের কারণে এখন ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি বর্তমানে পাঁচটি ব্যাংক গ্রাহকদের জমা টাকা ফেরত দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অন্য ব্যাংকগুলোও ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। বরং তারা সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগকে নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১ হাজার ৩০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ নিয়মিত করার জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীসহ আরও কিছু ব্যবসায়ীর ঋণ বিশেষ উদ্যোগে নিয়মিত করা হয়েছে। সেই সংখ্যা ইতিমধ্যে ৩০০ পেরিয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোরই উৎপাদন এখন বন্ধ রয়েছে।
বেকারত্ব বাড়ছে, কমছে কর্মসংস্থান
বেসরকারি খাতের এই স্থবিরতা শুধু ঋণ প্রবৃদ্ধির সংখ্যাতেই সীমাবদ্ধ নেই। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের উপরও। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। উল্টো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যমান চাকরিও হারাচ্ছেন অনেকে। ফলে দেশে দ্রুত গতিতে বাড়ছে বেকারত্ব।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই খাতে স্থবিরতা মানে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা। আর কর্মসংস্থান কমে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে, যা পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মূল্যস্ফীতি নাকি প্রবৃদ্ধি—কোনটা বেছে নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক?
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি জটিল দোটানায় রয়েছে। একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে বেসরকারি খাতকে চাঙা রাখা—দুটোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমানে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতিতে বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার, যার ফলে বেড়ে গেছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। কিন্তু এই পদক্ষেপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সময় এসেছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করার। না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই থমকে যেতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু সূচকে কিছুটা ইতিবাচক চিত্র দেখা গেলেও বেসরকারি খাতের স্থবিরতা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই খাতই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। তাই সরকারকে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে জোর দিতে হবে।
একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংককেও তার নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে। সুদহার কিছুটা কমিয়ে এনে বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি যাতে আবার না বাড়ে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এবং সঠিক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আগামী কয়েক মাসে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। তবে এজন্য দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা—সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে।