সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের নিরাপদ মজুত থাকা সত্ত্বেও এবং বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহের দাবি থাকলেও, বাংলাদেশের চালের বাজারে অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে। মিলারদের দাদন বাণিজ্য, ধানের অতিরিক্ত মজুতকরণ এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কারণে বোরোর ভরা মৌসুমেও চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত বছরের বন্যার ধাক্কা, যা আমন ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে—এক কেজি মোটা চাল কিনতেও ৬০ টাকা খরচ হচ্ছে, যখন সরু চালের দাম ৯০ টাকায় পৌঁছেছে। এই সংকটের মধ্যে সরকারের তদারকি দুর্বলতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে, যদিও সরকার আমদানি শুল্কমুক্ত করে দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে ভারতীয় চালের দামও ১৪% বেড়েছে, যা বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব ফেলছে।
সরকারি মজুত: পর্যাপ্ত কিন্তু অপ্রয়োগী?
খাদ্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুসারে, ১৩ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত গুদামে মোট ২২ লাখ ৮ হাজার ৯২৯ টন খাদ্যশস্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯১৬ টন, গম ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮১০ টন এবং ধান ৮০ হাজার ৩১৩ টন। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, মার্চ ২০২৫-এ সরকারি মজুত ১৪ লাখ টন চালের ছিল, যা এখনও সন্তোষজনক বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এই মজুত সত্ত্বেও বাজারে সংকট দেখিয়ে মিলাররা দাম বাড়াচ্ছে। গত অর্থবছরে (এফওয়াই২৫) বাংলাদেশ প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬০০% বেশি। বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি পূরণে সরকার শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দিয়েছে, যার ফলে ভারতে চালের দাম ১৪% বেড়েছে—স্বর্ণা জাতের চাল ৩৪ টাকা থেকে ৩৯ টাকা প্রতি কেজিতে উঠেছে।
মিলারদের কারসাজি: ধান কিনে মজুত, দাম বাড়িয়ে লাভ
কৃষকের মাঠ থেকে ধান মনপ্রতি ১১০০-১২০০ টাকায় কিনে গুদামজাত করেছেন মিলাররা। পরে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে নিজেরাই দাম বাড়াচ্ছেন। নওগাঁ জেলার চালকল মালিক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, জিরাশাইল ধানের দাম মনপ্রতি ১৫০ টাকা এবং কাটারি ধানের ১৫০-২০০ টাকা বেড়েছে, যা চালের উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে। কিন্তু কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “বোরো মৌসুমে চালের দাম কখনোই বাড়ার কথা নয়। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। তদারকি জোরদার করতে হবে।”
কাওরানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান যোগ করেন, “মিলারদের দাদন বাণিজ্যে এই অস্থিরতা। তারা ধান কিনে মজুত করেছে, এখন সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।” মালিবাগের খুচরা বিক্রেতা মো. দিদার হোসেন বলেন, “সরকার আমদানির অনুমতি দিয়েছে, চাল আসলে দাম কমবে। কিন্তু মিলাররা এখনও বাড়তি দামে বিক্রি করছে।”
সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, গত দু’দিনে ভারতে চালের দাম ১৪% বেড়েছে কারণ বাংলাদেশে রপ্তানি বেড়েছে। বাংলাদেশে এফওয়াই২৫-এ চালের দাম ১৬% বেড়েছে, যখন বিশ্ববাজারে চালের দাম ৮ বছরের সর্বনিম্নে। প্ল্যানিং কমিশনের জেনারেল ইকোনমিক্স ডিভিশন (জিইডি) বলছে, চালের দামই মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ, যা সরকারি ব্যবস্থা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
দামের তুলনামূলক ছক: তিন মাসের পরিবর্তন (৫০ কেজি বস্তা, টাকায়)
| চালের জাত | মিল পর্যায়ে বর্তমান দাম | তিন মাস আগে | পাইকারি বর্তমান দাম | তিন মাস আগে | খুচরা বর্তমান দাম (প্রতি কেজি) | তিন মাস আগে |
|---|---|---|---|---|---|---|
| মিনিকেট | ৩৮০০ | ৩৫০০ | ৩৯০০ | ৩৬০০ | ৮৫-৮৭ | ৮০ |
| নাজিরশাইল (২৫ কেজি) | ২০০০ | ১৮০০ | ২১৫০ | ১৯৫০ | ৯০ | ৮৫ |
| বিআর ২৮ | ২৯০০ | ২৭০০ | ২৯৫০ | ২৭৫০ | ৬৫ | ৬০ |
| স্বর্ণা (মোটা) | ২৭০০ | ২৫০০ | ২৭৫০ | ২৫৫০ | ৬০ | ৫৫ |
উৎস: মিল, পাইকারি ও খুচরা বাজার জরিপ, আগস্ট ২০২৫। সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাবে দাম আরও ১-৩ টাকা/কেজি বেড়েছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: তদারকি ও আমদানি, কিন্তু কার্যকরতা প্রশ্নবিদ্ধ
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা তিন পর্যায়ে তদারকি করছি। ঈদের পর থেকে চলমান। অবৈধ দাম বাড়ানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্ল্যানিং কমিশন দাম বৃদ্ধির তদন্তের সুপারিশ করেছে, যখন খাদ্য উপদেষ্টা বলছেন, “চালের দাম বৃদ্ধি রোধে মনিটরিং চলছে।” বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক (খানি) সতর্ক করে বলেছে, চালের দাম বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি খাদ্য সংকটকে তীব্র করছে, সরকারকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত বছরের বন্যায় আমন ফসলের ক্ষতির পর সরকার ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু আমদানি বন্ধ ছিল বলে মজুত কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের লোভই মূল কারণ। ক্রেতা জাহিদুল ইসলামের মতো সাধারণ মানুষ বলছেন, “বাজারে তদারকি নেই, দাম বাড়তি দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে।”
এই সংকট নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে, যখন বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে উলটো চিত্র। সরকারের আমদানি উদ্যোগ সফল হলে দাম কমতে পারে, কিন্তু ততক্ষণে মিলারদের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রাখলে গরিবের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠবে।