রাজনৈতিক বিভাজন ও আস্থাহীনতা দেশকে আবারও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তবর্তী সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা, প্রার্থীপদে মনোনয়ন যুদ্ধ এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উত্থান, সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত কিন্তু সক্রিয় সময় পার করছে দেশ। প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা নিয়ে যেমন জোর আলোচনা চলছে, তেমনি নতুন ও ইসলামিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এবার নির্বাচনের চিত্র পাল্টে দিতে পারে।

বিএনপি ইতিমধ্যে ২৩৭টি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে, যেখানে দীর্ঘদিনের স্থানীয় নেতারা অগ্রাধিকার পেয়েছেন। এতে দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য দৃঢ় হয়েছে, তবে তরুণ নেতৃত্বের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে সীমিত। নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তারেক রহমান, যিনি লন্ডন থেকে অনলাইন কৌশলগত নির্দেশনা দিচ্ছেন। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দলটির মাঠপর্যায়ের রাজনীতিকে কিছুটা প্রভাবিত করলেও বিএনপি মনে করছে, জনগণের ভোটে তারা পুনরায় জাতীয় রাজনীতির মূল ধারায় ফিরে আসতে পারবে।

অন্যদিকে, সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগ কঠিন এক বাস্তবতায় রয়েছে। দলটির নিবন্ধন স্থগিত থাকায় তারা সরাসরি “আওয়ামী লীগ” নামে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তবে ঘনিষ্ঠ নেতারা স্বতন্ত্র বা বিকল্প দলের ব্যানারে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে, এই “প্রক্সি প্রার্থীরা” মূলত সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়াসে নির্বাচনে অংশ নেবেন। এতে মাঠে একটি প্রতিযোগিতামূলক চিত্র তৈরি হলেও প্রকৃত অর্থে সরকারপন্থী ব্লক অটুট থাকবে।

এই রাজনৈতিক হিসাবের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। দীর্ঘদিন ধরে “তৃতীয় শক্তি” হিসেবে টিকে থাকা দলটি এবার নির্বাচনের ভারসাম্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দলটির ভেতরে এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থাকলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের সমর্থকদের মধ্যে আপোষের ইঙ্গিত মিলেছে। জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ২০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাপা যদি এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাহলে তারা “কিংমেকার” বা ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তাদের ভোটভিত্তি গ্রামীণ এলাকায় স্থিতিশীল, বিশেষ করে রংপুর, কিশোরগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে। ফলে যদি বড় দুটি দল সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকে, জাতীয় পার্টি তখন আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও বেশ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ইতিমধ্যেই শতাধিক আসনে প্রার্থী দিয়েছে, আর ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ডিজিটাল প্রচারণা শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এসব দল নগরকেন্দ্রিক এলাকায় ভোট ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে।

এই পরিবর্তনমুখী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামিক দলগুলোর ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা জামায়াতে ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ে আবারও সংগঠন পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছে। যদিও দলটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি, তবুও তাদের নেতারা স্বাধীনভাবে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নির্বাচনে যৌথ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

ধর্মভিত্তিক এসব দলের কার্যক্রম এখন তিনটি স্তরে ভাগ হয়েছে, এক, সামাজিক ও দানশীল কাজের মাধ্যমে ভোটভিত্তি তৈরি করা; দুই, বড় দলের সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতা করে ভোট প্রভাবিত করা; এবং তিন, সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘কিংমেকার’ ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা। বিশেষ করে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের কিছু এলাকাভিত্তিক প্রভাব, যেমন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল ও রাজশাহীতে, নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ইসলামিক দলগুলো এককভাবে ক্ষমতায় আসার মতো শক্তিশালী না হলেও, তারা ভোট ভাগাভাগির মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে ভারসাম্যের নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বড় দলগুলোর বিভাজন এবং ভোটারদের অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে তারা যদি জোট গঠন বা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে, তাহলে আসন্ন নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠনে তাদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ও আন্তর্জাতিক মহলের তদারকি মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৬ সালের প্রথমার্ধেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে ভোটার তালিকা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ে এখনও নানা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। ভোটের মাঠে সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য, এবং ডিজিটাল প্রোপাগান্ডার প্রভাবও এবার নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্য তুলে ধরছেন। এক, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং মাঠপর্যায়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে, তাহলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। দুই, বড় দলের বিভাজন ও নতুন দলের উত্থানে ভোট ভাগাভাগি হলে ‘হাং পার্লামেন্ট’-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তিন, ইসলামিক ও বিকল্প রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে যদি কেউ ৩০–৪০ আসনে জয়লাভ করে, তাহলে তারা ক্ষমতার ভারসাম্যে ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন পরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রধান দলগুলোর পাশাপাশি ইসলামিক ও নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান নির্বাচনের ফলাফলকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। ভোটের ফল শুধু সংখ্যার নয়, বরং অংশগ্রহণ, বিশ্বাসযোগ্যতা ও জনআস্থার প্রতিফলন হবে। একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায়সঙ্গত নির্বাচনই পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায় সূচনা করতে। অন্যথায়, রাজনৈতিক বিভাজন ও আস্থাহীনতা দেশকে আবারও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক