বায়ুদূষণের ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ঢাকা জেলার সাভার উপজেলাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ (Degraded Air Shed) হিসেবে ঘোষণা করেছে। বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২ এর বিধি ৫ অনুযায়ী রবিবার (১৭ আগস্ট) পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান এনডিসি স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে এই ঘোষণা জারি করা হয়। এই পদক্ষেপ জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং রাজধানী ঢাকাসহ সাভারের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কঠোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর:
এই ঘোষণার ফলে আগামী সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে সাভার উপজেলায় টানেল কিলন এবং হাইব্রিড হফম্যান কিলন ব্যতীত সকল ধরনের ইটভাটায় ইট পোড়ানো ও উৎপাদন কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। এছাড়া, উন্মুক্ত অবস্থায় কঠিন বর্জ্য পোড়ানো, বায়ুদূষণ সৃষ্টিকারী নতুন শিল্প কারখানার জন্য অবস্থানগত ও পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান, এবং কর্মপরিকল্পনায় উল্লিখিত অন্যান্য দূষণকারী কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই বিধিনিষেধগুলো সাভারের বায়ুমান উন্নত করতে এবং জনস্বাস্থ্যের উপর দূষণের মারাত্মক প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বায়ুদূষণের ভয়াবহ চিত্র:
পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রের (CAMS) তথ্য অনুযায়ী, সাভারের পরিবেষ্টক বায়ুর বার্ষিক গড় দূষণ মাত্রা জাতীয় মানের প্রায় তিন গুণ বেশি। এই অত্যধিক দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে, বিশেষ করে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, হৃদরোগ এবং শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে (প্রায় পাঁচ মাস) উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত বাতাস সাভারের দূষিত বায়ু ঢাকায় নিয়ে আসে, যা রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার ইটভাটাগুলো শহরের বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের জন্য দায়ী।
প্রেক্ষাপট ও সরকারের পদক্ষেপ:
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাভারের বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত ইটভাটা, কঠিন বর্জ্য পোড়ানো, এবং শিল্প কারখানার নির্গমন। এর আগে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঘোষণা করেছিলেন যে, বায়ুদূষণ কমাতে নতুন ইটভাটার অনুমতি দেওয়া হবে না। এছাড়া, পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া পরিচালিত ৩,৪৯১টি ইটভাটা বন্ধ এবং পাহাড়ি এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত ইটভাটাগুলো স্থানান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। উচ্চ আদালতও ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী অবৈধ ইটভাটা অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিল।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় আশা:
সরকারের এই ঘোষণাকে সাভার ও ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সাভার ও ঢাকার বায়ুমান উন্নত হবে এবং জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্তদের জন্য এটি স্বস্তির কারণ হবে। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বিধিনিষেধ কার্যকর করতে কঠোর তদারকি এবং স্থানীয় সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ:
যদিও এই ঘোষণা বায়ুদূষণ কমাতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে ইটভাটা শ্রমিকদের জীবিকা এবং শিল্প কার্যক্রমের উপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সরকার জানিয়েছে, টেকসই প্রযুক্তি (যেমন, টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান কিলন) ব্যবহারকারী ইটভাটাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে, এবং বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া, পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেশব্যাপী বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পরিকল্পনা ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সাভারের এই ঘোষণা বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষার পথে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।