ক্যান্সার একটি ভয়াবহ রোগ যা বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে। এটি এমন একটি রোগ যা শরীরের অস্বাভাবিক কোষবৃদ্ধির মাধ্যমে শুরু হয় এবং তা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ক্যান্সার দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবসটি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ এবং কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানায়। এখানে আমরা ক্যান্সার ও ক্যান্সার দিবসের গুরুত্ব, ক্যান্সারের প্রকারভেদ, লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার এবং সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করব।
ক্যান্সার কী?
ক্যান্সার হলো একটি মারাত্মক রোগ যা শরীরের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা বিভাজন থেকে শুরু হয়। সাধারণত, শরীরের কোষগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভাজিত হয় এবং তারপর মরে যায়। তবে, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই কোষবৃদ্ধি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে, যেমন – ফুসফুস, স্তন, প্রোস্টেট, কিডনি, লিভার এবং হাড়।
ক্যান্সারের প্রকারভেদ
ক্যান্সারের অনেক ধরনের প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন:
- স্তন ক্যান্সার: মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সারের প্রকার এটি। এর মধ্যে স্তনের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
- ফুসফুস ক্যান্সার: ফুসফুসের কোষে ক্যান্সার হতে পারে, যা ধূমপান বা পরিবেশগত দূষণের কারণে হতে পারে।
- প্রোস্টেট ক্যান্সার: পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়, বিশেষত যাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি।
- কলোরেকটাল ক্যান্সার: এই ধরনের ক্যান্সার অগ্নাশয়, মলদ্বার বা বড় আন্ত্রে হতে পারে।
- লিভার ক্যান্সার: লিভারের কোষে ক্যান্সার হতে পারে, বিশেষত যদি কেউ দীর্ঘদিন হেপাটাইটিস বা অন্যান্য লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
- গলার ক্যান্সার: এটি গলায়, খাদ্যনালির ভিতরে, বা মাড়ির কোষে হতে পারে।
এছাড়া আরও অনেক প্রকার ক্যান্সার রয়েছে, যেমন গুরদা ক্যান্সার, ডিম্বাশয় ক্যান্সার, মস্তিষ্কের ক্যান্সার, ইত্যাদি।
ক্যান্সারের কারণ
ক্যান্সারের সঠিক কারণ জানা না গেলেও কিছু বিষয় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে:
- ধূমপান: ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ। তামাকের মধ্যে থাকা রাসায়নিক উপাদানগুলো ক্যান্সারের সৃষ্টি করতে পারে।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন: অ্যালকোহল শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষত লিভার ক্যান্সার।
- অতিরিক্ত ওজন: অতিরিক্ত মেদ শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- পারিবারিক ইতিহাস: যদি পরিবারের মধ্যে কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকে, তবে সেই ব্যক্তির ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- বিকিরণ: অতিরিক্ত রেডিয়েশন বা বিকিরণের সংস্পর্শে আসলে ক্যান্সার হতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: বেশি তেল, চিনি, এবং লাল মাংসের খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ক্যান্সারের লক্ষণ
ক্যান্সারের লক্ষণ রোগের প্রকারভেদ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে, তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে যা দেখে ক্যান্সারের শঙ্কা করা যেতে পারে:
- অস্বাভাবিক দেহে ফোলাভাব বা গাঁথ: বিশেষ করে স্তন বা গলার অঞ্চলে অস্বাভাবিক গাঁথ দেখা দিলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকতে পারে।
- অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ: মূত্র বা মলদ্বার থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত, স্তন থেকে রক্তপাত ইত্যাদি হতে পারে।
- অস্বাভাবিক ব্যথা: শরীরের কোনো স্থানে অবিরাম ব্যথা হতে থাকলে এটি ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে।
- ওজন কমে যাওয়া: কোন কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
- থাকতে থাকা কাশি বা শ্বাসকষ্ট: বিশেষত যদি কাশি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এর সঙ্গে রক্তপাত থাকে।
ক্যান্সারের চিকিৎসা
ক্যান্সারের চিকিৎসা সাধারণত তিনটি মূল পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে করা হয়:
- সার্জারি (অপারেশন): ক্যান্সারের টিউমার বা কোষ অপসারণের জন্য সার্জারি করা হয়। এটি সাধারণত প্রথম দফার চিকিৎসা পদ্ধতি।
- কেমোথেরাপি: ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে এবং তাদের বৃদ্ধি আটকাতে শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহৃত হয়।
- রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যান্সারের কোষগুলোর বৃদ্ধি থামাতে রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করা হতে পারে।
ক্যান্সার দিবসের গুরুত্ব
৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হয়, যার উদ্দেশ্য ক্যান্সার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং এই রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করা। বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ক্যান্সারের প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ, এবং চিকিৎসা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। এই দিনটি বিভিন্ন দেশে সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এছাড়া, ক্যান্সারের চিকিৎসার প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত হলে এর চিকিৎসা অনেক সহজ এবং সফল হতে পারে।
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:
- স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ক্যান্সার শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষত যাদের পরিবারের ইতিহাসে ক্যান্সার রয়েছে, তাদের প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করা উচিত।
- ধূমপান পরিহার: ধূমপান মুক্ত জীবন যাপন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
- শারীরিক ক্রিয়াকলাপ: নিয়মিত ব্যায়াম এবং শরীরকে সক্রিয় রাখলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়।
- আবেগিক সমর্থন: ক্যান্সার রোগী এবং তাদের পরিবারকে মানসিকভাবে সমর্থন জানানো প্রয়োজন। এটি রোগীকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে।
ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ, তবে এটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হলে এবং নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করলে এটি পরাজিত করা সম্ভব। ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস আমাদের এই রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এবং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আরও একযোগে কাজ করার একটি সুযোগ। ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের জন্য আমাদের সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে এবং একে মোকাবিলা করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।