গত দেড় বছরে অনেক ওষুধের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে; হাই কোর্ট বলেছে—জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য সরকার নির্ধারণ করবে।
ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণহীনতা সাধারণ মানুষের জন্য এখন সরাসরি জীবন-ঝুঁকি তৈরি করছে। গত দেড় বছরে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় রোগী ও তাদের পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে—এর ফলে হাজার হাজার পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। ভোক্তারা এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মনে করছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আরও কঠোর তদারকির প্রয়োজন; না হলে কোম্পানি ও ফার্মেসির যৌথ অবস্থান চূড়ান্তভাবে ওষুধ কেনাবেচাকে অপ্রাপ্য করে তুলছে।
কেন দাম বাড়ছে — কোম্পানির দাবিকথা ও সংশয়ের পার্থক্য:
ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, ডলার সংকট, এলসি জটিলতা, উপকরণ ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিতে দায়ী করছে। তবে বাজার-তথ্য ও ভোক্তাদের অভিযোগ বলছে, শুধু কাঁচামালের কারণ নয়—বড় কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মার্কেটিং ব্যয়, ডাক্তারদের অনুপ্রেরণা (ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, নগদ অর্থ) ও মেডিকেল রেপ্রেজেনটেটিভদের জন্য লাখ লাখ টাকা ব্যয়কেও দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। প্রতিযোগিতার নামে অসুস্থ চর্চাও চালু রয়েছে—ফার্মেসি পর্যায়ে কিছু ওষুধের দাম আরও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভোক্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর প্রভাব:
যখন চাল-রুটি বা অন্যান্য খাবার মুল্য বেড়ে গেলে ভোক্তা কাটছাঁট করে বাঁচিয়ে নিতে পারে, কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে সেভাবে কাজ করে না — চিকিৎসা শুধুমাত্র সম্পূর্ণ ডোজ নিলে সুফল দেয়; ডোজ কমিয়ে দিলে রোগ জটিল হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্যের প্রতিফলন হিসেবে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে—এবং স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার কারণে অনেকে বিনা চিকিৎসায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের বড় অংশই ব্যক্তিরা নিজের পকেট থেকে দিচ্ছেন এবং বিকৃত বাজারে ওষুধের উপরই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়।
বাজার পরিস্থিতি: দাম এবং অনিয়মের উদাহরণ:
রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি ও বিক্রেতাদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়—অ্যাজিথ্রোমাইসিন, প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিক ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম গত দেড় বছরে লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। একই রোগের জন্য বাজারে একই প্রকারের ওষুধের দাম কোম্পানিভেদে বড় ফারাক দেখা যায়—কোনো কোনো ব্র্যান্ডে প্রতি পিস দরের তফাৎ কয়েক গুণ। এতে ক্রেতা বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং সাশ্রয়ী বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও হাই কোর্টের নির্দেশ:
এই পরিস্থিতিতে হাই কোর্ট একটি আবেদন (রিট) নিয়ে শুনানি শেষে নির্দেশ দিয়েছে যে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য সরকার নির্ধারণ করবে এবং তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে—যাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা হয়। বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। তবে কার্যকর কেবল রায় দিলেই হবে না—প্রয়োজন তা বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিক নজরদারির। বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে বোঝা যায়, দাম নিয়ন্ত্রণে পরিমিতি ও স্বচ্ছতা না থাকলে রায়ের বাস্তব প্রভাব সীমিত থাকবে।
খাত সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য ও সমাধান:
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে—ডলার ও কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি সহ বহুমুখী চাপ রয়েছে, আর এমআরপি (ম্যাক্সিমাম রিটেইল প্রাইস) নির্ধারণ করার প্রক্রিয়াটি বাজার পরিস্থিতি যাচাই করে হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা অনিয়মিত ও দেরিতে হয়েছে। অন্যদিকে ভোক্তা সংগঠন, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ফার্মাসি মালিকদের অনেকে দাবি করছেন—ঔষধ প্রশাসনকে কড়াকড়ি শিক্ষণীয় মানদণ্ড, মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা, নিয়মিত বাজার নজরদারি এবং কোম্পানি-ফার্মেসি উভয় পর্যায়ে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এছাড়া মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও ডাক্তার-প্রতারণা রোধেরও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
পরিসংখ্যান ও বাস্তব চিত্র:
ওষুধবাজার বাংলাদেশে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকার; ৩১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে পূরণ হয় এবং রপ্তানিও রয়েছে—তবে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণশূন্যতা এই সাফল্যের স্বাদ ক্ষুণ্ন করছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি হিসাবও বলছে—জনগণের স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ওষুধ কেনার ওপর ব্যয় হয়, যা পরিবারগুলোর জীবিকা ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা ব্যাহত করছে।
ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা না হয়েছে—এলে শুধুমাত্র আর্থিক নাজুকতা বাড়বে না, বরং জনস্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। হাই কোর্টের রায় হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কিন্তু সেটি বাস্তবে রূপ দিতে হলে ঔষধ প্রশাসন, অর্থনীতি বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংস্থা ও ওষুধ শিল্পের মধ্যে সমন্বিত ও স্বচ্ছ কার্যকারিতা জরুরি। না হলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে—এবং সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।