বাংলাদেশে চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ, শিশু খাদ্য, কসমেটিক পণ্য এবং খাদ্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্যদ্রব্যের মান এবং কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বাজারে এই ধরনের পণ্যের একাধিক ভেরিয়েন্ট সহজলভ্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব পণ্যের বেসিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত নয়। এর ফলে, জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতি হতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিম্নমানের বা ভেজাল পণ্য বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহারের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে, তা অনেক সময় অবহেলিত থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে ভুল ফলাফল প্রদান করতে পারে। এছাড়া, শিশু খাদ্যে ভেজাল বা অপর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
শিশু খাদ্যের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের বাজারে প্রাপ্ত শিশুখাদ্যের ৪০ শতাংশই মানহীন। একই সময়ে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) ৫০টির বেশি খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও নিম্নমান সনাক্ত করে। চিকিৎসা সামগ্রী ও ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ পণ্য অনুমোদিত মান পূরণে ব্যর্থ হয়। কসমেটিক সামগ্রীর ক্ষেত্রে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানীয় বাজারে বিক্রিত পণ্যের মধ্যে ৩০ শতাংশ সামগ্রীর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়।
বর্তমান আইন, যেমন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, এই সমস্যাগুলোর নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও তদারকির অভাবে অনেক নিম্নমানের পণ্য বাজারে সহজেই প্রবেশ করছে। নিয়মিত পরিদর্শন ও বাজার মনিটরিংয়ের অভাব এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং সংরক্ষণ বন্ধ করতে সরকারের শক্তিশালী উদ্যোগ প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের সমন্বয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। পণ্য উৎপাদন এবং আমদানির ক্ষেত্রে মান নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করা, ভোক্তাদের জন্য একটি কেন্দ্রিয় অভিযোগ ব্যবস্থাপনা তৈরি করা, বাজারে বিক্রিত প্রতিটি পণ্যের ডিজিটাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা, ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য শনাক্তকরণে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পণ্যের মান নির্ধারণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সহায়ক হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী পণ্যের মান নিশ্চিত করতে অনলাইন এবং ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশেও QR কোডের মাধ্যমে পণ্যের উৎস এবং মান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, অনলাইন ডাটাবেস তৈরি করে অনুমোদিত ও নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে হবে।
নিম্নমানের পণ্যদ্রব্য ও সেবা জনস্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব ফেলছে তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এর প্রতিকার নিশ্চিত করতে সরকার, উৎপাদক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাসহ সকল পক্ষের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। আইন ও নিয়ম কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক (রুবেল) | জনসাস্থ্য ও পরিবেশ কর্মী