আলাদা লাইন না থাকা, চিকিৎসায় সময় নিয়ে কথা না শোনা, অচ্ছুত মানুষ হিসেবে দেখাসহ নানা কারণে হিজড়া জনগোষ্ঠী সরকারি হাসপাতালে বৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে পিছিয়ে পরা এ জনগোষ্ঠী সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত। তারা অর্থাভাবে ক্লিনিক বা প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে সেবা নিতেও পারেন না। ফলে রোগে ভুগতে হয়। সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা পেতে বেগ পেতে হয় লিঙ্গভিত্তিক এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে।
অভিযোগ উঠেছে, হিজড়া জনগোষ্ঠীর চিকিৎসায় বৈষম্য মারাত্মক আকার। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করার জন্য আলাদা লাইন নেই, ফলে হিজড়া জনগোষ্ঠী পুরুষ বা মহিলা লাইনে দাঁড়ালে বের করে দেয়া হয়। এ অবস্থার কারণে পরিচয় গোপন ও কথা না বলে পুরুষ বা মহিলা লাইনে দাড়ান। কিন্তু চিকিৎসকের কক্ষে গেলেই বিপত্তি ঘটে। চিকিৎসকরা এ জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন। অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী বলে মনে করেন। ভর্তি হলে ওয়ার্ডে গিয়ে বেড পেতে সমস্যা হয়। কারণ ওয়ার্ডে হিজড়া জনগোষ্ঠীর আলাদা কোন বেড নেই। কখনও সহানুভূতির সাথে বেড পেলেও ওয়ার্ডের লোকজন স্বাভাবিক আচরণ করেন না। ফলে সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা পেতে বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হয়। সেখানে আবার চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। সবাই সেখানে যেতে পারে না।
হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির একজন ওয়াচডগ সদস্য বলেন, ‘লিঙ্গ ভিত্তিক বৈচিত্র্য থাকার কারনে হিজড়ারা পরিবারের সাথে থাকতে পারে না। আর্থিক সংকট, সম্মান না পাওয়া, অবজ্ঞা অবহেলার শিকার হওয়া, বৈবাহিক ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা কারণে এ জনগোষ্ঠী মানসিক সমস্যায় পরেন। তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এ জনগোষ্ঠী চিকিৎসা নিতে গিয়ে সঙ্কটে পরেন। তাদের কারও কারও মেডিকেল কাউন্সিলিং প্রয়োজন হয়। কিন্তু খুলনায় এ ধরনের ব্যবস্থা নেই। তাই অনেক সময়ে এদের মধ্যে কেউ কেউ আত্নহত্যা পর্যন্ত করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়’।
সম্প্রতি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে চন্দনা মন্ডল (২০) নামে এক হিজড়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে আত্নহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। প্রাথমিক চিকিৎসায় সুস্থ হলেও পরবর্তীতে সঠিক ভাবে চিকিৎসা না নেয়ার কারনে তিন মাস পরে তার মৃত্যু হয়। চন্দনার গুরুমা জুঁই জানান, অনেক মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন চন্দনা। যার কারণেই সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। আমরা অনেক চেষ্টা করে তাকে চিকিৎসা নেয়ার জন্য রাজি করিয়েছিলাম। সে মাঝে মধ্যে চিকিৎসা নিত। কিন্তু হারপিক পান করার আড়াই মাসের মাথায় আবারও সমস্যা প্রকট হয় এবং সে মৃত্যুবরণ করে।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করা ছিন্নমুল মানব কল্যান সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা দিতে ভয় পান চিকিৎসকরা। তাদের রোগের বিবরণ শোনার আগেই ওষুধ লিখে কক্ষ থেকে বিদায় করেন। তবে হিজড়া জনগোষ্ঠী যৌন রোগের সেবাটা ভালো পান। অন্য রোগের সেবা সুষ্ঠু হয় না। মেরী স্টোপস বা ফ্যামিলি প্লানিং এ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ- এফপিএবি তে সেবা নিতে যান না হিজড়া জনগোষ্ঠী। তারা চিকিৎসা সেবা পেতে আগ্রহী সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে লাইনে দাড়ানো থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরেই সমস্যায় পরেন এ জনগোষ্ঠীর মানুষ। হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করা এনজিওর সহায়তা ছাড়া এদের স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা হয় না।
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, এ হাসপাতালে কোন রোগীকেই আলাদা দৃষ্টিতে দেখা হয় না। সকলকেই প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হয়। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রাপ্ততা বিবেচনায় নেয়া হয়। যদি কোন চিকিৎসক বা হাসপাতালের কেউ হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে থাকে সে তথ্যটি সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া গেলে তাকে মোটিভেশনের আওতায় নেয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এ হাসপাতালে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে প্রয়োজন বোধে ভর্তিও করা হয় এবং চিকিৎসা দেয়া হয়।
খুলনা মহানগরীর কয়েকটি এলাকায় অবস্থিত হিজড়া ডেরায় থাকেন মৌসুমী, ললিতা, রাণী (ছদ্মনাম) সহ অনেক হিজড়া। তাদের সাথে কথা বললে তারা জানান, সরকারি কিংবা বেসরকারি সব হাসপাতালেই চিকিৎসা সেবা নেয়াটা তাদের জন্য কিছুটা বিব্রতকর। তাদের নানান ভাবে কটুক্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে অশোভন প্রশ্ন করা হয়। যা তাদেরকে চিকিৎসা সেবা নিতে অনাগ্রহী করে তোলে।
এ বিষয়ে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ওয়াচডগ সদস্য বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানে হাসপাতালগুলোতে অ্যাডভোকেসি সভা করা জরুরী। হিজড়ারাও মানুষ কিন্তু তারা এমন মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এই সমস্যা লাঘবে ‘বন্ধু’ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করছে এবং অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করছে’।
২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার মত। কিন্তু বেসরকারী তথ্যমতে এই সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি এবং তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে চিকিৎসাসেবা সহ তাদের সব মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা জরুরী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, হিজড়ার সং্খ্যা ১২৬৩৯, এবং বেসরকারি তথ্যমতে ৫০ হাজারের কাছাকাছি