তখন সময় সকাল ৯টা ৫ মিনিট (আজ সোমবার)। একটি নীল রঙের বড় আকারের প্রিজন ভ্যান হুইসেল বাজিয়ে ঢাকার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানার সামনের ফটকে এসে দাঁড়ায়।
প্রিজনভ্যান থেকে নামেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তাঁকে পুলিশের নারী সদস্যরা আদালতের হাজতখানার ভেতর নিয়ে যান।
সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিমসহ অন্যদের আগে থেকেই এই হাজতখানায় এনে রাখা হয়েছিল। দীপু মনিকে হাজতখানায় নেওয়ার ৩০ মিনিট পর সেখান থেকে প্রথমে হাজী সেলিমকে বের করে আনেন পুলিশ সদস্যরা। তাঁর পরনে দেখা যায় ঢিলেঢালা সাদা রঙের পাঞ্জাবি।
গণমাধ্যমকর্মীদের দেখার পর হাজী সেলিম হাসতে থাকেন। এ সময় তাঁর দুই হাত ধরে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা।
হাজী সেলিমের ঠিক পেছনে ছিলেন সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
এরপর একে একে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ অন্যদের সিএমএম আদালতের চতুর্থ তলার এজলাসকক্ষে আনা হয়।
আদালতের এজলাসকক্ষে আগে থেকে আসামিদের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে এজলাসে আসেন বিচারক।
‘কারা কর্তৃপক্ষ হাজী সেলিমের কথা বুঝছে না’
বিমর্ষ হাজী সেলিমকে আসামির কাঠগড়ায় তোলার পর তিনি চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে পুলিশ।
হাজী সেলিমের আইনজীবী প্রাণনাথ রায় আদালতে তাঁর মক্কেলের জামিন চেয়ে আবেদন করেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার মক্কেল কোনো কথা বলতে পারেন না। তিনি অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। আগে তিনি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি সেখানে প্রথম শ্রেণির কারাবন্দী হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাঁকে কেরানীগঞ্জ থেকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’
আইনজীবী প্রাণনাথ রায় আদালতকে আরও বলেন, কাশিমপুর কারাগারে যাওয়ার পর তাঁর মক্কেলকে কোনো প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। কারা কর্তৃপক্ষ হাজি সেলিমের কোনো কথা বুঝছে না। তিনি সেখানে বেশ সমস্যায় রয়েছেন। আদালত যদি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দেন, তাহলে তাঁর মক্কেল অনেক উপকার পাবেন।
হাজী সেলিমের জামিনের বিরোধিতা করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে হাজী সেলিমের জামিন আবেদন নাকচ করেন। তাঁকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চিঠি লিখলেন দীপু মনি
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০ টা। জনাকীর্ণ আদালতে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমানসহ অন্যদের দুটি মামলায় রিমান্ড আবেদনের শুনানি চলছিল।
এ সময় আসামির কাঠগড়ার দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপু মনি। তাঁর সামনে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। তাঁর বাম পাশে দাঁড়িয়েছিলেন হাসানুল হক ইনু।
একপর্যায়ে দেখা যায়, দীপু মনির বাম হাতে কয়েকটি টিস্যু পেপার। আর ডান হাতে কলম। দীপু মনি টিস্যুর ওপর কিছু লিখতে শুরু করেন।
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে টিস্যু পেপারের ওপর ‘চিঠি’ লিখেন দীপু মনি। কাঠগড়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির (আইনজীবীর পোশাক পরা) হাতে দীপু মনি চিঠিটি তুলে দেন। এরপর ওই ব্যক্তি নিজের মুঠোফোনে চিঠির ছবি তোলেন। তিনি টিস্যু পেপার তাঁর বাঁ হাতে ভাঁজ করে রাখেন। চিঠির ছবি তোলার বিষয়টি তিনি আকারে-ইঙ্গিতে দীপু মনিকে জানান।
আদালতে দেখা যায়, দীপু মনি জনৈক ব্যক্তির হাতে চিঠি হস্তান্তরের পর তিনি জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে কথা বলেন। সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও দীপু মনিকে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা যায়।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চিঠি লেখার বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, এজলাসকক্ষের যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি শুনানি করছিলেন, সেখান থেকে কাঠগড়া কিছুটা দূরে। আদালতে অনেক আইনজীবী ছিলেন। জনাকীর্ণ আদালতে দীপু মনির চিঠি লেখার বিষয়টি তাঁর নজরে আসেনি। যদি নজরে আসত, তাহলে অবশ্যই তিনি আদালতের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনতেন। কারণ, একজন আসামি আদালতের হেফাজতে থাকেন। আদালতের অনুমতি ছাড়া এখানে তিনি তিনি চিঠি লিখতে, হস্তান্তর করতে পারেন না। কিংবা আইনজীবী ব্যতীত অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা যায় না।
দীপু মনির আইনজীবী গাজী ফয়সাল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মক্কেল এ ধরনের কোনো চিঠি লিখেছেন কি না, তা তাঁর নজরে আসেনি। কারণ, জনার্কীর্ণ আদালতে তিনি সামনের দিকে অবস্থান করছিলেন। শুনানিতে ব্যস্ত ছিলেন।
দীপু মনিকে যাত্রাবাড়ী থানার পৃথক দুটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে।
চুপচাপ আনিসুল, সাবেক দুই আইজিপির কথোপকথন
আদালতে দেখা যায়, হাজতখানা থেকে আনিসুল হককে যখন এজলাসকক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তাঁর দুই হাত ছিল সামনে। বিমর্ষ মুখে এজলাসকক্ষে ঢুকে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন আসামির কাঠগড়ায়। তিনি কেবল তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। এরপর তিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন আসামির কাঠগড়ায়। তাঁর পাশে সালমান এফ রহমান দাঁড়িয়ে থাকলেও তিনি কোনো কথা বলেননি।
আনিসুল হকের খুব কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক আইজিপি শহিদুল হক ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। প্রায় পাঁচ থেকে দশ মিনিট ধরে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন।
আসামির কাঠগড়ার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাশেদ খান মেনন। তাঁর বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। তবে তাঁরা দুজনই তাঁদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন।
আজ শুনানি নিয়ে আদালত আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দুটি হত্যা মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন হত্যা মামলায় জুনায়েদ আহমেদ পলক, ফজলে করিম চৌধুরী ও শহিদুল হককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।