বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চান ট্রাম্প কেন, কী আছে সেখানে?

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাওয়ার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, আমরা সেই ঘাঁটিটি ফেরত চাই। এটা চীনের পারমাণবিক অস্ত্র কারখানার কাছে, কৌশলগত জায়গায় অবস্থিত।

কেন হঠাৎ ফেলে আসা বিমানঘাঁটি আবারও নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছেন ট্রাম্প?

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি ছিল দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র।

সোভিয়েত যুগে নির্মিত এ ঘাঁটিকে মার্কিন সেনারা ব্যবহার করেছিল আফগানিস্তান যুদ্ধের মূল ঘাঁটি হিসেবে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর, সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে বসে মার্কিনিরা। তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তালেবানদের পতনের পর বাগরাম ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয় মার্কিন বাহিনী। নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঘাঁটিতে ব্যপক উন্নয়ন করে যুক্তরাষ্ট্র।

২০১২ সালের দিকে এক লাখেরও বেশি মার্কিন সেনা অবস্থান করত সেখানে। বিস্তীর্ণ রানওয়ে, ভারী অবকাঠামো, সামরিক বিমান ওঠানামার সুবিধা, গোয়েন্দা তৎপরতা, লজিস্টিকস—সব মিলিয়ে বলা যায় এটি ছিল এক কথায় ‘মিনি-আমেরিকা’। একে একে আমেরিকার তিনজন প্রেসিডেন্ট—জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প সফর করেন এই ঘাঁটিতে। ঘাঁটিটির বড় সুবিধার মধ্যে একটি ছিল এটির বিস্তীর্ণ রানওয়ে।

এর মধ্যে একটি ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। রানওয়েটিতে সহজেই বিশাল আকৃতির সামরিক কার্গো জাহাজ ওঠা নামা করতে পারে। 

এমনকি ঘাঁটিতে মার্কিন সেনাদের জন্য বার্গার কিং ও পিৎজা হাটের মতো রেস্তোরাঁও চালু ছিল। ঘাঁটির ভেতরে ছিল একটি বিশাল কারাগারও। একে আফগানিস্তানের ‘গুয়ানতানামো বে’ নামে ডাকা হতো।

বাগরাম পুনর্দখলে ট্রাম্পের উচ্চাভিলাষ: ভূরাজনৈতিক দাবার নতুন চাল

মধ্য এশিয়ার কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আফগানিস্তানের বাগরাম এয়ারবেস পুনর্দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জটিল ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং আঞ্চলিক শক্তির তীব্র বিরোধিতা।

এশিয়া নিয়ন্ত্রণের মাস্টারপ্ল্যান

ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, বাইডেন প্রশাসনের ২০২১ সালের আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার ছিল আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কৌশলগত ভুলের একটি। তার যুক্তি, বাগরাম শুধুমাত্র আফগানিস্তানে আমেরিকার উপস্থিতি বজায় রাখার জন্য নয়, বরং চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি অপরিহার্য কৌশলগত অবস্থান।

“চীনের পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র এক ঘণ্টার ফ্লাইট দূরত্বে অবস্থিত বাগরাম,” জোর দিয়ে বলেন ট্রাম্প। তার দাবি, এই অবস্থান থেকে সমগ্র এশিয়া মহাদেশের উপর নজরদারি এবং প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব।

অতীতের সিদ্ধান্তের বিরোধাভাস

বিড়ম্বনার বিষয় হলো, নিজের প্রথম প্রেসিডেন্সির সময়েই ট্রাম্প তালেবানের সাথে ‘দোহা চুক্তি’ স্বাক্ষর করে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তবে তার বর্তমান অবস্থান হলো, সেনা প্রত্যাহারের পরেও বাগরামের মতো কৌশলগত ঘাঁটিগুলো আমেরিকার নিয়ন্ত্রণেই রাখা উচিত ছিল।

বাস্তবায়নের জটিল চ্যালেঞ্জ

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাগরাম পুনর্দখল করা একটি অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন হবে:

  • ব্যাপক সেনা মোতায়েন: কমপক্ষে ১০,০০০ সেনা সদস্য
  • উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম
  • নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলা: আইএস, আল-কায়েদা এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার বিরুদ্ধে সুরক্ষা

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তালেবান সরকার ইতিমধ্যেই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে।

তালেবানের দৃঢ় প্রত্যাখ্যান

কাবুলের তালেবান প্রশাসন ট্রাম্পের প্রস্তাবকে সরাসরি নাকচ করেছে। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, “আমেরিকার সাথে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা আগ্রহী, কিন্তু আফগান ভূখণ্ডে কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতি কখনোই মেনে নেওয়া হবে না।”

আঞ্চলিক শক্তির কৌশলগত প্রতিক্রিয়া

চীনের উদ্বেগ

বেইজিং এই পরিকল্পনাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান স্পষ্ট করে বলেছেন, “আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার একমাত্র আফগান জনগণের।”

রাশিয়া-ইরানের অবস্থান

মস্কো এবং তেহরান উভয়েই তাদের প্রভাব বলয়ে আমেরিকার এই সামরিক উপস্থিতির তীব্র বিরোধী। তারা বুঝতে পারছে যে, বাগরামের নিয়ন্ত্রণ মানেই মধ্য এশিয়ায় আমেরিকার আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

ইউরেশিয়ার নিয়ন্ত্রণ: চূড়ান্ত পুরস্কার

ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাগরামের কৌশলগত গুরুত্ব এর ভৌগোলিক অবস্থানেই নিহিত। এই ঘাঁটি থেকে:

  • সমগ্র মধ্য এশিয়ায় নজরদারি সম্ভব
  • চীন-রাশিয়া-ইরানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়
  • ইউরেশিয়ান ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তার সম্ভব

মধ্য এশিয়ার এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ যে পাবে, তার হাতেই থাকবে সমগ্র ইউরেশিয়ার ভাগ্যের চাবি।

নতুন শীতল যুদ্ধের আভাস

ট্রাম্পের এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নতুন মাত্রার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে। মস্কো-বেইজিং-তেহরানের ত্রিপক্ষীয় জোট কখনোই চাইবে না তাদের কৌশলগত এলাকায় আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি ফিরে আসুক।

এদিকে ওয়াশিংটনের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে তালেবানের বিরোধিতা, আঞ্চলিক শক্তির প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক জনমতের চাপ মোকাবেলা করে এই লক্ষ্য অর্জন করা যায়।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাগরাম পুনর্দখলের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ দেখাচ্ছে। তবে ট্রাম্পের এই ঘোষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আমেরিকা মধ্য এশিয়ায় তার প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন আরও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে এই বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক এবং কৌশলগত দর-কষাকষির ফলাফলের উপর।। সূত্র: বিবিসি