রেলপথ মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারণে সৃষ্ট সংকটের কথা
দেশের রেলপথে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা। শুধুমাত্র গত তিন মাসেই প্রায় ৩০টি স্থানে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা দেশের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও জনপ্রিয় গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থায় ফাটল ধরাচ্ছে।
রেলপথ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্রিটিশ আমলের জরাজীর্ণ রেলপথ, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, ফিশ প্লেটের অভাব, লোকোমোটিভের নিম্নমান এবং বগির বেহাল অবস্থা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
৩৯ জেলার রেলপথে নানামুখী সমস্যা
দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৩টিতে রেলপথ থাকলেও এর মধ্যে ৩৯টি জেলার রেলপথেই রয়েছে মারাত্মক সমস্যা। রেলের নথি অনুযায়ী, প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার রেললাইনের অবস্থা ভালো নয়।
পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, ময়মনসিংহসহ ১৬টি জেলায় এবং পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা বিভাগের ২৩টি জেলায় সমস্যা প্রকট।
সাম্প্রতিক কয়েকটি বড় দুর্ঘটনা
পাবনায় পঞ্চগড় এক্সপ্রেস: গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গুড়া স্টেশনে পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগ কয়েক ঘণ্টা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শত শত যাত্রী ভোগান্তির শিকার হন।
জয়পুরহাটে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস: ৯ সেপ্টেম্বর ভোররাতে আক্কেলপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের পাওয়ার কারের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। লাইনচ্যুত বগি ফেলে রেখেই মাত্র পাঁচটি বগি নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা অব্যাহত রাখে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেস: ৬ সেপ্টেম্বর কলেজপাড়া লেভেলক্রসিং এলাকায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকায় বিমানবন্দর স্টেশন: ২৩ আগস্ট সকালে বিমানবন্দর স্টেশন এলাকার কাছে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ঢাকামুখী লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
রাজশাহীতে লোকাল ট্রেন: ২৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঈশ্বরদী রুটের সিক্স ডাউন ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। প্রায় চার ঘণ্টা পর বগিটি উদ্ধার করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের স্বীকারোক্তি
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান স্বীকার করেছেন যে, বিগত সময়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমরা এখন পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করছি। সংকট কেটে যাবে।”
যাত্রীদের ভোগান্তি ও আস্থার সংকট
প্রতিটি লাইনচ্যুতির ঘটনায় শুধু জানমালের ক্ষতিই হচ্ছে না, হাজার হাজার যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনে আটকে পড়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। রেলপথকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী গণপরিবহন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এই ক্রমাগত দুর্ঘটনা মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিচ্ছে।
রেল বিভাগের সূত্রমতে, জরুরি ভিত্তিতে বিপজ্জনক এলাকাগুলোতে সংস্কারকাজ শুরু করার পরিকল্পনা চলছে। তবে প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার রেললাইন সংস্কারের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বাজেট ও সময়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলাফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রেলপথ পুনরুদ্ধারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে জরুরি।