ঋণের জামিনদার: বিশ্বাসের মূল্য দিতে গিয়ে সর্বস্ব হারানোর গল্প


গত বছর আগস্ট মাসের এক সকালে চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিকারক শাহীন হাওলাদার ব্যাংকে গিয়েছিলেন একটি এলসি খোলার কাজে। নিয়মিত কাজ, রুটিন মাফিক। কিন্তু সেদিন তাঁর জীবনে নেমে আসে এক অভাবনীয় দুর্যোগ। ব্যাংক কর্মকর্তা জানালেন, তিনি এখন ঋণখেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি ডাটাবেজে তাঁর নাম উঠে গেছে কালো তালিকায়।
শাহীন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। দুই দশকের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে তিনি কখনো একটি টাকাও বাকি রাখেননি। তাহলে হঠাৎ এই অভিযোগ কেন? পরে জানতে পারলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়েছে ২১ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে—যে ঋণ তিনি কখনো নেননিই।
আসল কারণটা ছিল অন্য জায়গায়। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনিসুর রহমানের ঋণের জামিনদার হয়েছিলেন তিনি। বন্ধুত্বের টানে, দুই যুগের বিশ্বাসের সূত্রে। কিন্তু বন্ধুর ব্যবসা যখন ভেঙে পড়ল, তখন দায় এসে পড়ল শাহীনের ঘাড়ে।


যে ফাঁদে পা দিচ্ছেন হাজারো মানুষ
শাহীন একা নন। সারাদেশে এমন হাজারো মানুষ আছেন, যারা বন্ধু-আত্মীয়ের ঋণের জামিনদার হয়ে নিজেরাই এখন আসামির কাঠগড়ায়। সম্পত্তি হারাচ্ছেন, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, পরিবার নিয়ে পথে বসার উপক্রম।
আইনটা এরকম—যদি মূল ঋণগ্রহীতা খেলাপি হন, তাহলে জামিনদারও স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়ী। সিআইবিতে তাঁর নামও উঠে যায়। ব্যাংক চাইলে আদালতের মাধ্যমে জামিনদারের সম্পত্তিও নিলামে তুলতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমরান আহমেদ ভুঁইয়া বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “বর্তমান অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী ঋণখেলাপি হলে মূল গ্রহীতা এবং জামিনদার—দুজনের বিরুদ্ধেই মামলা করা যায়। মূল ঋণগ্রহীতার বন্ধকী সম্পত্তি দিয়ে পুরো টাকা না উঠলে জামিনদারের সম্পত্তিও নিলামে যেতে পারে।”
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—জামিনদার যদি পুরো খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেন, তাহলে সেই টাকা তিনি মূল ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কীভাবে আদায় করবেন, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেই এই আইনে।


শাহীনের গল্প: বন্ধুত্বের দায়
২০১৭ সালে টঙ্গীতে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান জনতা ব্যাংক থেকে ২১ কোটি টাকার ঋণ নেন। কারখানা আর জমি বন্ধক রাখা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংক আরও নিরাপত্তা চাইলে আনিসুর তাঁর বন্ধু শাহীনের কাছে যান।
“আমরা প্রায় বিশ বছরের বন্ধু। ব্যবসায়িক সম্পর্কও ছিল। তাই যখন সে বলল তার দরকার, আমি ভেবেচিন্তে রাজি হয়ে গেলাম,” বলছিলেন শাহীন। “কোনোদিন ভাবিনি যে এই সিদ্ধান্ত আমার জীবনে এমন ঝড় বয়ে আনবে।”
কিন্তু আনিসুরের ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সুদে-আসলে ঋণ দাঁড়ায় ৩৩ কোটি টাকায়। ব্যাংক তখন আইন মোতাবেক আনিসুর এবং শাহীন—দুজনকেই খেলাপি ঘোষণা করে গাজীপুর অর্থঋণ আদালতে মামলা ঠুকে দেয়।
শাহীন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ব্যাংক চাইলে আমাকে এই বিপদে ফেলতে পারতো না। যে কারখানা আর জমি বন্ধক ছিল, সেগুলো বিক্রি করলেই তো পুরো টাকা উঠে যেত। কিন্তু তারা সোজা আমার নাম তালিকায় তুলে দিল। রাতারাতি আমার ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কেউ আর আমার সাথে লেনদেন করতে চাইলো না।”
অবশেষে হাইকোর্টে রিট করে সাময়িকভাবে সিআইবির তালিকা থেকে নাম সরাতে পেরেছেন শাহীন। তবে মামলা এখনও চলছে।


মনতাজুরের বেদনা: শ্যালকের ঋণে হারালেন সব
মনতাজুর রহমানের ভাগ্য শাহীনের মতো ভালো হয়নি।
২০১১ সালে তাঁর শ্যালক আতাউর রহমান এবি ব্যাংক থেকে নেন ৪ কোটি টাকার ঋণ। রড-সিমেন্টের পাইকারি ব্যবসা বড় করার স্বপ্ন ছিল। মনতাজুর, একজন আপন আত্মীয় হিসেবে, জামিনদার হতে রাজি হন।
কিন্তু আতাউর সেই টাকা দিয়ে অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ব্যবসায় ধস নামে। আতাউর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় থাকে না। সুদে-আসলে ঋণ বেড়ে হয় ৭ কোটি টাকা।
নারায়ণগঞ্জের অর্থঋণ আদালত আতাউরের বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের আদেশ দেয়। কিন্তু সেখান থেকে ওঠে মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা। বাকি সাড়ে ৩ কোটি টাকা?
ব্যাংক তখন তাকায় মনতাজুরের দিকে।


“ফতুল্লায় আমার একটা ফুয়েল স্টেশন ছিল। ১১ কাঠা জমি। সেটাই ছিল আমার একমাত্র সম্পদ,” বলছিলেন মনতাজুর, কণ্ঠ ভারী হয়ে। “আদালত ব্যাংককে অনুমতি দেয় আমার সম্পত্তি নিলামে তুলতে। কিন্তু কোনো ক্রেতা পাওয়া গেল না। শেষে পুরো সম্পত্তিটাই ব্যাংক নিজের নামে করে নিল।”
হাইকোর্টে রিট করেছিলেন, আপিল বিভাগেও গিয়েছিলেন। কিছুতেই কিছু হয়নি। এখন মনতাজুরের পরিবার দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।
“সে আমার আপন শ্যালক। ভাবলাম, তার ব্যবসা বড় হবে, সবার ভালো হবে। কিন্তু কপালে ছিল না,” বলতে বলতে থেমে যান মনতাজুর।


আদালতের নথিতে ভয়াবহ চিত্র
গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শুধু ঢাকার সাতটি অর্থঋণ আদালতেই খেলাপি ঋণ আদায়ের ৩১ হাজার ৩০৯টি মামলা চলমান। এসব মামলার সাথে জড়িত প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
এর মধ্যে ১০ হাজার ২১১টি মামলায় জামিনদারকেও বিবাদী করা হয়েছে, যেখানে জড়িত প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার অর্থঋণ আদালত ১,১২৯টি মামলায় রায় দিয়েছে—এসবের সাথে জড়িত ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০৮টি মামলায় জামিনদারও হেরেছেন।
২০২৪ সালে রায় হয় ৯৩৯টি মামলায়, ২০২৩ সালে ৪২৮টিতে, ২০২২ সালে ১,২২৪টিতে, এবং ২০২১ সালে ১,৬২১টি মামলায়। প্রতিটিতেই শত শত জামিনদার তাদের সম্পত্তি হারিয়েছেন।
হাইকোর্টে ছুটছেন জামিনদাররা


আত্মরক্ষার শেষ আশ্রয় এখন হাইকোর্ট।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিআইবি থেকে নাম সরানোর জন্য ৭৪৮টি রিট করা হয়েছে, যার সাথে জড়িত ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৫৪ জনের নাম স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। বাকিরা এখনও আইনের চোখে খেলাপি।
২০২৪ সালে এমন রিট হয়েছিল ১,২৩৫টি, যার ৮৬৬টিতে স্বস্তি পেয়েছিলেন জামিনদাররা।
একইভাবে সম্পত্তি নিলাম ঠেকাতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৩১টি রিট করা হয়, যার ১৩৯টিতে সাময়িক স্থগিতাদেশ পাওয়া গেছে। এসব নিলামের সাথে জড়িত ছিল ৪,৫০০ কোটি টাকা।
২০২৪ সালে নিলাম ঠেকাতে ৪৫৮টি রিট হয়েছিল, যার সাথে জড়িত ছিল সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতের অবস্থান


বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ব্যাংকগুলো সবকিছু আইনের মধ্যে থেকেই করে। কাউকে জোর করে ঋণ নিতে বা জামিনদার হতে বাধ্য করা হয় না।
“ঋণগ্রহীতার যদি পরিচ্ছন্ন ইতিহাস থাকে, ব্যাংক সেই অনুযায়ী ঋণ অনুমোদন দেয়। তবে বর্তমানে জামিনদার নিয়োগের প্রবণতা অনেকটাই কমেছে,” বলেন তিনি।
এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এ. (রুমী) আলী বলেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই জামিনদারের ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশেও তা আইনসম্মত।
“তবে জামিনদার হওয়ার আগে অবশ্যই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঋণ খেলাপি হলে মূল গ্রহীতার পাশাপাশি জামিনদারও বিপদে পড়বেন—এটা মাথায় রাখতে হবে,” পরামর্শ দেন তিনি।
আইন সংশোধনের দাবি


আইনজীবী এমরান আহমেদ ভুঁইয়া মনে করেন, ব্যাংক যখন স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক নিচ্ছে, তখন আলাদাভাবে জামিনদার নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
“আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি। যে ঋণগ্রহীতা পর্যাপ্ত বন্ধক দিতে পারবে না, তাকে ব্যাংক ঋণই দেবে না—এটাই হওয়া উচিত। অন্য একজনকে জামিনদার বানিয়ে অযথা হয়রানির মধ্যে ফেলা একধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন,” জোর দিয়ে বলেন তিনি।