রোববার সকালে দিল্লির ১৭১ স্কোর মানে সেখানকার বাতাস সাধারণ মানুষের জন্যও অস্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে ঢাকার ৭৪ স্কোর মাঝারি মানের—যদিও দীর্ঘমেয়াদে এটাও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
ঢাকার বায়ুদূষণ: তিন প্রধান অপরাধী
২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার বাতাস দূষিত করার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে।
প্রথমত, শহরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ইটভাটা। এগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া সরাসরি ঢাকার বাতাসে মিশে যায়। শীতকালে যখন বাতাসের চলাচল কম থাকে, তখন এই ধোঁয়া আরও ঘনীভূত হয়ে শহরের ওপর চাপের মতো চেপে বসে।
দ্বিতীয়ত, লাখো যানবাহনের নিঃসৃত কালো ধোঁয়া। বিশেষ করে পুরনো বাস, ট্রাক এবং অটোরিকশা থেকে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত গ্যাস বের হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় যানজট যেহেতু নিত্যদিনের ঘটনা, তাই ইঞ্জিন চালু রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো থেকে দূষণ বাড়ছে কয়েক গুণ।
তৃতীয়ত, শহরজুড়ে চলমান নির্মাণকাজ। উড়ন্ত সিমেন্টের গুঁড়ো, বালির ধুলা, ভাঙা ইটের গুঁড়ো—এসব মিলে তৈরি হচ্ছে পিএম২.৫ ও পিএম১০ নামের অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যা সরাসরি ফুসফুসে ঢুকে যায়।
পাঁচটি মারাত্মক উপাদান
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয় পাঁচটি প্রধান দূষক পদার্থের উপস্থিতি দেখে:
১. পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম১০ ও পিএম২.৫): অতি সূক্ষ্ম কণা, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু শ্বাসের সাথে ফুসফুসে ঢুকে যায়
২. নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (এনও২): গাড়ির ধোঁয়া থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত গ্যাস
৩. কার্বন মনোক্সাইড (সিও): অসম্পূর্ণ দহন থেকে তৈরি বিষাক্ত গ্যাস
৪. সালফার ডাই-অক্সাইড (এসও২): শিল্পকারখানা থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর গ্যাস
৫. ওজোন (ও৩): ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি তৈরি হওয়া ক্ষতিকর ওজোন স্তর
যে রোগগুলো লুকিয়ে আছে দূষিত বাতাসে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণ এখন নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। দূষিত বাতাস থেকে যেসব রোগ হতে পারে:
স্ট্রোক: মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া
হৃদরোগ: হার্ট অ্যাটাক ও করোনারি আর্টারি ডিজিজ
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি): দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট
ফুসফুসের ক্যানসার: দূষিত বাতাসে থাকা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ থেকে
তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ: নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস
ডব্লিউএইচওর হিসাব অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে গড়ে ১৩ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে শুধুমাত্র দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কারণে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
বায়ুদূষণ সব বয়সের মানুষের জন্যই ক্ষতিকর, তবে কিছু মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন:
শিশুরা: তাদের ফুসফুস এখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। দূষিত বাতাসে বেড়ে উঠলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
বয়স্কদের: বয়সের সাথে সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। দূষিত বাতাস তাদের জন্য বিশেষভাবে মারাত্মক।
অসুস্থ ব্যক্তিরা: যাদের হাঁপানি, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস আছে, তাদের জন্য দূষিত বাতাস প্রাণঘাতী হতে পারে।
গর্ভবতী মায়েরা: দূষিত বাতাস গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা দিতে পারে, এমনকি অকাল প্রসবের কারণও হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, এবং বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দূষিত বাতাস একই জায়গায় জমে থাকছে বেশি সময় ধরে।
বিশেষ করে শীতকালে যখন তাপমাত্রা কম থাকে এবং বাতাসের গতি কমে যায়, তখন শহরের ওপর তৈরি হয় দূষণের একটি ঘন আস্তরণ—যাকে বলা হয় ‘স্মগ’। দিল্লি প্রতি বছর শীতে এই স্মগের কারণে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।