ফুলবাড়িগেট থেকে টেলিগাতী পর্যন্ত সড়কের বেহাল দশায় ভ্যানচালক থেকে শিক্ষার্থী—সবাই বিপাকে
খুলনা, ৬ অক্টোবর— “মাজায় আর কুলাচ্ছে না, ঝাঁকি খেতে খেতে জীবন শেষ। কিছুদিন পর পর ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে। ভ্যানেরও অবস্থা বেহাল। প্রতিদিন ভ্যানগাড়ি মেরামতের জন্য গ্যারেজে নিতে হচ্ছে”— ফুলবাড়িগেট-কুয়েট সংযোগ সড়কের প্রবেশদ্বারে ইজিবাইক স্ট্যান্ডে নিজ ভ্যানে বসে একনাগাড়ে কথাগুলো বললেন ভ্যানচালক মো. শহীদ হাওলাদার।
শহীদ হাওলাদারের মতো আড়াই শতাধিক ইজিবাইক, ভ্যান এবং রিকশাচালক প্রতিদিন এই সড়কে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু সড়কের বেহাল দশার কারণে তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
তিন বছরেও শেষ হয়নি আধুনিকায়ন
খুলনা সিটি কর্পোরেশন সিআরবি প্রজেক্ট-২’র আওতায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ফুলবাড়িগেট থেকে ল্যাবরেটরি হাই স্কুল পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ, ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড এই কাজ পেলেও কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ১ হাজার ১৮৮ মিটার সড়কের আধুনিকায়নের কাজ তিন বছরেও শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দু’দফা সময় বাড়ানোর পরও কাজ সম্পন্ন হয়নি। বর্তমানে সড়কটির কাজ বন্ধ রয়েছে। এদিকে গভঃ ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে টেলিগাতী পাঁকারমাথা পর্যন্ত মাত্র ৪০০ মিটার সড়ক সংস্কারের কাজও গত এক বছরে শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার আলমগীর ফকির। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) দিঘলিয়া উপজেলার আওতাধীন ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের কাজও গত তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
প্রতিদিন ১৫ হাজার মানুষের দুর্ভোগ
এই সড়কটি শুধু একটি সাধারণ রাস্তা নয়—এটি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এর ৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী, ১১ শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াতের একমাত্র পথ। এছাড়া গভঃ ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ১১ শতাধিক, প্রতিভা প্রি-ক্যাডেট স্কুল ও মিজান একাডেমীর ৬ শতাধিক, খুলনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহস্রাধিক, খুলনা মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাড়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থীসহ মোট ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রতিদিন এই সড়ক ব্যবহার করেন।
শলুয়া রংপুর এবং টেলিগাতী এলাকার ৫ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদেও এই সড়ক অপরিহার্য। সড়কটির দু’পাশে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং দোকানপাট রয়েছে।
ভাঙাচোরা সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি
সড়কের মাঝখানে বেশ কয়েকটি বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ভ্যান, ইজিবাইক, সাইকেল আরোহীরা প্রায়শই গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। দু’পাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলে সড়কের উপর হাঁটু পানি জমে এবং তখন যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে দুর্ভোগের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সড়কের দুরাবস্থার কারণে মাতৃত্বকালীন কোনো মহিলা এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে পারছেন না।
শহীদ হাওলাদার জানান, “আজ টায়ার নষ্ট, বাল্ব-টিউব নষ্ট, তো কাল টিউব নষ্ট, পরশুদিন চাকা টাল—মানে প্রতিদিন একটা না একটা ঝামেলা লেগে আছে। গাড়ির পিছনে টাকা খরচ করতে করতে মরে গেলাম। ঝাঁকুনির কারণে প্যাসেঞ্জার কেউ ভ্যান গাড়িতে উঠতে চায় না। আয়-রোজগার একেবারে কমে গেছে। সংসার চালাতে পারছি না।”
ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
টানা তিন বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের প্রধান সড়কটির বেহাল অবস্থার কারণে ক্ষুব্ধ কুয়েট প্রশাসন। দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তাগিদেও কর্ণপাত করছে না ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী এবিএম মামুনুর রশিদ।
অভিযোগ রয়েছে, সড়কটির সংস্কারের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রকৌশলীর তাগিদেও কর্ণপাত করছেন না ঠিকাদার আলমগীর ফকির। কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে কেউ বলতে পারছেন না।
ভ্যানচালক শহীদ হাওলাদার আক্ষেপ করে বলেন, “রাস্তা সমান থাকলে গাড়ি চালাতে আরাম পেতাম, প্যাসেঞ্জারও উঠতো। মিল-কলকারখানা সব বন্ধ। কি আর করব। কষ্ট হলেও ভ্যান গাড়ি চালিয়ে খেতে হবে।”
প্রতিদিন ৫ শতাধিক যানবাহনসহ ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের এই দুর্ভোগের অবসান কবে হবে—সেই প্রশ্ন এখন সবার মুখে।