রোদ-বৃষ্টির এই অস্থির আবহাওয়া এডিস মশার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজার ১৯৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ২২৪ জন। শুধু অক্টোবরের প্রথম ১০ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ এবং মারা গেছেন ২৬ জন।
গত বছর অক্টোবর-নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বৃষ্টি এভাবে চলতে থাকলে অক্টোবরেই সেপ্টেম্বরের রেকর্ড ভেঙে যেতে পারে। এমনকি ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিস্তার থাকতে পারে।
থেমে থেমে বৃষ্টিই মূল কারণ
জনস্বাস্থ্যবিদরা জানিয়েছেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, পলিথিন, খাবারের প্যাকেট, ডাবের খোসা, ছোট পাত্র—যেখানেই পানি জমছে, সেখান থেকেই এডিস মশার লার্ভা বিস্তার লাভ করছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “মাঝখানে ডেঙ্গু কিছুটা কমেছিল। এখন বৃষ্টি হওয়ায় আবার বেড়েছে। অক্টোবরেও বাড়তে থাকবে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, “যতদিন বৃষ্টি থাকবে, ততদিন ডেঙ্গুর ঝুঁকি থাকবেই। গত বছরও অক্টোবর-নভেম্বরে পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। এ বছরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন। আগামী তিন মাস পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”
কোন বয়সীরা বেশি ঝুঁকিতে?
বয়স বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা। এই বয়সসীমার মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বয়সের মানুষ কর্মজীবী হওয়ায় বেশি চলাফেরা করেন এবং মশার সংস্পর্শে বেশি আসেন।
মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২২৪ জনের মধ্যে ১১৭ জন পুরুষ এবং ১০৭ জন নারী। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগীদের মধ্যে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ নারী।
বিগত বছরগুলোর তুলনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৭৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয়। সে বছর আক্রান্ত হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২০২৪ সালে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের।
চলতি বছরের মাসওয়ারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৫ হাজার ৯৫১ জন (মৃত্যু ১৯), জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন (মৃত্যু ৪১), আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন (মৃত্যু ৩৯) এবং সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮৬৬ জন (মৃত্যু ৭৬)।
দেরিতে হাসপাতালে আসছেন রোগীরা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, “সব জ্বরের রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। অনেকেই দেরি করে হাসপাতালে আসছেন, এতে চিকিৎসা জটিল হয়ে যাচ্ছে। অল্প অবহেলাতেও বড় ক্ষতি হতে পারে।”
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন একটি দিন পার হয়েছে। কিন্তু ওই দিনও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩০৮ জন। গতকাল ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকা মহানগরের ৮৭ জন, বরিশালের (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ১১৫ জন, চট্টগ্রামের ৮৫ জন এবং ময়মনসিংহের ২১ জন।
জনসচেতনতাই একমাত্র পথ
জনস্বাস্থ্যবিদরা জোর দিয়ে বলছেন, নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে। তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে। ফুলের টব বা কোনো পাত্রে যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। মশারি ব্যবহার করতে হবে এবং জ্বর অনুভব করলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, “জরুরি ভিত্তিতে মশা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। নইলে আগামী তিন মাস পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, রোগী বাড়লে মৃত্যুও বাড়ে। তাই এখনই সচেতন হওয়া এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।