গাজায় সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি চুক্তির কালি শুকানোর আগেই নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গত ১০ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল, তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। উভয় পক্ষের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে গাজার সাধারণ মানুষই পড়ছে সবচেয়ে বড় বিপদে।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস রবিবার এক চাঞ্চল্যকর বিবৃতিতে জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ইসরায়েল অন্তত ৪৭ বার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এই সহিংসতায় ৩৮ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন এবং আরও ১৪৩ জন আহত হয়েছেন। অভিযোগ করা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী বেসামরিক মানুষের ওপর সরাসরি গুলি চালিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে গোলাবর্ষণ করেছে এবং বেশ কয়েকজন সাধারণ নাগরিককে গ্রেফতার করেছে।
রবিবারই গাজা উপত্যকার বিভিন্ন প্রান্তে নতুন করে হামলার খবর এসেছে। দক্ষিণে রাফা এবং উত্তরে জাবালিয়ায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে দু’জন নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
গাজা কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘ এবং চুক্তির মধ্যস্থতাকারীদের কাছে জরুরি হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছে। তারা দাবি করেছে, ইসরায়েলকে তাদের আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য করা হোক।
মানবিক সহায়তায় নতুন বাধা
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা রাখা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, রাফা সীমান্ত ক্রসিং বন্ধই থাকবে যতক্ষণ না হামাস গাজায় থাকা সব মৃত ইসরায়েলি বন্দিদের দেহ ফেরত দেয়। অথচ এই ক্রসিং দিয়েই মূলত খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি ত্রাণসামগ্রী গাজায় প্রবেশ করে।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, হামাসের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসার পরপরই প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে গাজায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র আভিচাই আদরাই দাবি করেছেন, তাদের সামরিক অভিযান ছিল যুদ্ধবিরতির চরম লঙ্ঘনের জবাব। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল আরও দৃঢ় ও শক্তিশালীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অভিযোগ করেছে, হামাস গাজার ভেতরে তাদের সৈন্যদের ওপর রকেট ও স্নাইপার হামলা চালিয়েছে।
হামাসের অস্বীকার
তবে হামাস এই সব অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। তারা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাফা এলাকায় কোনো ধরনের সংঘর্ষ বা ঘটনার কথা তাদের জানা নেই। হামাস বলেছে, তারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলতে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই টানাপোড়েনের মধ্যে গাজার সাধারণ মানুষ আবারও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারার আগেই নতুন সংঘাতের ছায়া তাদের জীবনে নেমে এসেছে।
দুই বছরের ভয়াবহতা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৬৮ হাজার ১৫৯ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ২০৩ জন আহত হয়েছেন। সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একটি পরিবারের বিধ্বস্ত জীবন।
দুই বছরের এই যুদ্ধে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন। গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় পুরো জনসংখ্যা এখন বেঁচে থাকার জন্য মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
ভঙ্গুর এই যুদ্ধবিরতি টিকবে কিনা, সে প্রশ্ন এখন সবার মনে। গাজার মানুষ প্রতিদিন জেগে ওঠে এই ভয় নিয়ে যে আজকের দিনটা কেমন যাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ এবং উভয় পক্ষের সংযমই হয়তো পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে। তবে এখনও পর্যন্ত সেই আশার আলো ক্ষীণ।