তামাক কোম্পানির কূট-কৌশল: গিফটের মোড়কে মরণফাঁদ

বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ি তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতক্ষ ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন, প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হলেও, এসব কোম্পানি এখন নানা কূট-কৌশলে ৩০ বছরের নিচের বয়সি কিশোর ও যুবকদের টার্গেট করে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ ও (২০১৩-সংশোধনী) অনুযায়ী, তামাকজাত পণ্যের যেকোনো ধরনের প্রচার, উপহার বিতরণ, বা স্পন্সরশিপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোম্পানিগুলো এই আইনকে বৃদ্ধাআঙ্গুলি দেখিয়ে বিভিন্ন প্রমোশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যার অন্যতম মাধ্যম হলো তথাকথিত ‘গিফট’ বা উপহার সামগ্রী বিতরণ। এই গিফটগুলো শুধু ব্র্যান্ডের নাম ছড়িয়ে দিতে নয়, বরং তরুণ সমাজের মাঝে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ তৈরি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতের ভোক্তা সৃষ্টি করে তামাক ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখেই এর মূল উদ্দেশ্য।

তামাক কোম্পানিগুলো সাধারণত দুই ধরণের টার্গেট গ্রুপকে প্রাধান্য দেয়, একদিকে তরুণ সমাজ, অন্যদিকে খুচরা বিক্রেতা বা দোকানদার। তরুণদের মাঝে ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন ব্যক্তিগত ব্যবহার্য পণ্য যেমন ক্যাপ, টি-শার্ট, জ্যাকেট, লাইটার, অ্যাশট্রে, ওয়ালেট, রিস্টব্যান্ড, ছাতা, পানির বোতল, মগ, কলম ও নোটবুকের মতো জিনিস আকর্ষনীয়ভাবে তৈরী করে উপহার দেয়। এসব পণ্যে স্পষ্টভাবে কোম্পানির নাম বা লোগো ব্যবহার করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে লোগো ব্যবহার না করে ব্যন্ডের কালার ব্যবহার করে থাকে, যেন ব্র্যান্ডটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ফলে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের ‘কুল’ ভাব তৈরি হয় এবং তারা অজান্তেই তামাক ব্র্যান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

অন্যদিকে দোকানদার ও বিক্রেতাদের কাছে কোম্পানিগুলো আরও কৌশলী। নির্দিষ্ট বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে তাদের দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রণোদনা ও উপহার- যেমন ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, ফ্যান, ডিনারসেট, সাবান, শ্যাম্পু, মোবাইল ফোন, ব্লেন্ডার, ডিসপ্লে র‍্যাক, গ্লাস কাউন্টার বা দোকানের সাইনবোর্ড। এমনকি অনেক সময় বিক্রেতাদের নগদ অর্থ, গিফট ভাউচার বা বোনাসও দেওয়া হয়। বর্তমানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের দোকানগুলো সম্পূর্নভাবে কালার ব্রান্ডিং করে দিচ্ছে এবং বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে মুদি মালামালের প্যাকেজ গিফট হিসেবে প্রদান করছে। এতে দোকানদাররা উৎসাহিত হয়ে সেই নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের তামাকজাত পণ্য বেশি বিক্রি করে, যা সরাসরি বিক্রয় বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণে সহায়তা করছে।

শুধু দোকান বা তরুণ সমাজই নয়, তামাক কোম্পানিগুলো এখন ইভেন্ট ও ডিজিটাল মাধ্যমকেও পরোক্ষ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা বিভিন্ন বাইকার ইভেন্ট, মিউজিক কনসার্ট, গেম টুর্নামেন্ট বা কুইজ প্রতিযোগিতার আড়ালে নিজেদের ব্র্যান্ডকে তুলে ধরছে। এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হেলমেট, ব্যাগ, টি-শার্ট, স্মার্টফোন বা গিফট কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে। আবার অনলাইনেও চলছে ডিজিটাল প্রমোশন- সোশ্যাল মিডিয়া কনটেস্ট, অনলাইন কুইজ, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ও গেমিং অ্যাপের মাধ্যমে তামাক ব্র্যান্ড প্রচারিত হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তরুণদের অবচেতন মনে তামাক কোম্পানিগুলো এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থার জায়গা তৈরি করছে।

এই সমস্ত প্রচেষ্টা আসলে একধরনের গোপন বিপণন কৌশল, যার মূল লক্ষ্য নতুন প্রজন্মকে তামাকের দিকে টেনে আনা। প্রতিটি ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট বা লাইটার আসলে একটি নতুন আসক্ত ভোক্তা তৈরির প্রতীক। তামাক কোম্পানিগুলো জানে, বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও মানুষের মনকে প্রভাবিত করা এখনো সম্ভব গিফট ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে। তাই তারা এই ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে ‘কর্পোরেট সোস্যাল রিসপন্সিবিলিটি’ বা ‘স্পন্সরশিপ’ নামের আড়ালে নিজেদের বিপণন চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে এই কর্মকাণ্ডগুলো স্পষ্টতই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের পরিপন্থী। আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি তামাকজাত পণ্যের ব্র্যান্ডনাম, লোগো বা রঙ ব্যবহার করে কোনো ধরনের উপহার সামগ্রী বিতরণ, পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রচারণা চালাতে পারবে না। এ ধরনের কার্যক্রম প্রমাণিত হলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব অপরাধের বিচার খুবই সীমিত, যা তামাক কোম্পানিগুলোর দুঃসাহসকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তামাক কোম্পানীর এই গোপন প্রমোশন শুধু আইনের লঙ্ঘন নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত বিনিয়োগ। তরুণদের মনস্তত্ত্বে গিফটের মাধ্যমে ব্র্যান্ডের ইতিবাচক ইমেজ স্থাপন করা মানে ভবিষ্যতের আসক্ত প্রজন্ম তৈরি করা। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরো যুগউপযোগী করে সংশোধন করে বাস্তবায়ন করা এবং কোম্পানির এই গোপন ফাঁদ চিহ্নিত করে তা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্মকেও এই সচেতনতামূলক আন্দোলনে যুক্ত হতে হবে। কারণ প্রতিটি গিফট আসলে একটি ধূমপানের আমন্ত্রণ, আর প্রতিটি লাইটার মানে ভবিষ্যতের একটি নিভে যাওয়া জীবন।

সূত্র: কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক, সদস্য, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ বাস্তবায়নে গঠিত বিভাগীয় টাস্কফোর্স কমিটি, খুলনা।