এক পায়ে নেচে নতুন কুঁড়ির সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে নওরিন

জন্ম থেকেই বাঁ পা নেই। কখনো ক্রাচে ভর করে, কখনো এক পায়েই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। কিন্তু সেই এক পায়েই মঞ্চজুড়ে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সুনামগঞ্জের নুরফিজা হক নওরিন। নতুন কুঁড়ির সাধারণ নৃত্য শাখার ‘ক’ গ্রুপে সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে এই অদম্য শিশু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার নাচের ভিডিও এখন ভাইরাল।

গত ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের শান্তিবাগ রোডে নওরিনদের বাসায় গেলে দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল গানের আওয়াজ। চলছিল নওরিনের প্রশিক্ষণ। শুক্রবার থেকে নতুন কুঁড়ির চূড়ান্ত পর্ব শুরু হওয়ার খবর এসেছে। এক পায়ে নেচে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় পার হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে সে। ১০ জনের মধ্যে পেয়েছে সর্বোচ্চ নম্বর। এখন লড়াই সেরা তিনে থাকার। ২৪ থেকে ২৯ অক্টোবর ঢাকায় চলবে চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা।

‘ওয়ান লেগ, ওয়ান লেগ’

অস্ত্রোপচারের টেবিলে পৃথিবীর আলো দেখে নওরিন। মুহূর্তে দূর হয়ে যায় মা আছমা বেগমের সব কষ্ট। কিন্তু পাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘ওয়ান লেগ, ওয়ান লেগ।’ তখনো কিছু বুঝতে পারেননি আছমা। শুধু জানতে চান, সন্তান কেমন আছে। পরে স্বজনেরা জানান, নবজাতকের একটি পা নেই।

মা আছমা বেগম বলেন, “মেয়েটা এভাবে এক পায়ে মঞ্চে নাচবে, সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে, মানুষ তাকে চিনবে—এমনটা কখনো ভাবিনি।” মেয়ের শুরুর দিকের গল্প বলতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। আবার যখন মেয়ের সাফল্যের কথা শোনান, তখন তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে আনন্দ।

আছমা বেগম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সাক্তারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। সেই স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে নওরিন। পড়াশোনায়ও সে ভালো, ক্লাসে রোল এক। নৃত্যের পাশাপাশি আবৃত্তি ও আঁকাআঁকিও করে।

মুঠোফোনে দেখে শেখা নাচ

নওরিনের নৃত্যচর্চা শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। শুরুতে কোনো নৃত্যশিক্ষক ছিল না, মুঠোফোনে ভিডিও দেখে দেখেই শিখেছে। গত বছর স্কুলের হয়ে উপজেলা পর্যায়ের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে মায়ের সঙ্গে জেলা শহরে আসে। অনুষ্ঠান শেষে দৃষ্টি তালুকদার নামের এক তরুণী তাকে শহরের ‘বাতিঘর’ নামের একটি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

প্রথমে রাজি হননি আছমা। মেয়ের এক পা নেই, যদি কোনো সমস্যা হয়। কিন্তু দৃষ্টি মাকে বোঝান, নওরিনের দায়িত্ব তিনি নেবেন। একপর্যায়ে মা রাজি হন। মেয়ের সুবিধার জন্য শহরে একটি বাসাও ভাড়া নেন তিনি।

গত বছর শহরের হাসন রাজা মিলনায়তনে নাচার সুযোগ পায় নওরিন। বাতিঘর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক দেওয়ান গিয়াস চৌধুরীর আয়োজনে মঞ্চে ওঠে সে। নওরিনের এক পায়ের নাচ দেখে বিস্মিত হন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াসহ অন্যরা। পরে তাকে ডেকে নিয়ে উপহারও দেন জেলা প্রশাসক। ওই দিনের পর থেকেই সবাই জানতে পারে নওরিনের কথা।

‘এই মেয়ে অনেক দূর যাবে’

নওরিনের নৃত্যশিক্ষক দৃষ্টি তালুকদার বলেন, “আসলে নওরিনের মাঝে যেটা আছে, সেটা গড গিফটেড। ঢাকায় বিচারকেরা পরিষ্কার বলেছেন, আবেগ বা নওরিনের একটা পা যে নেই, এটি তাঁদের চিন্তায় ছিল না। তাঁরা তার মেধার মূল্যায়ন করেছেন। এই মেয়ে অনেক দূর যাবে।”

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ভাদেরটেক গ্রামে নওরিনদের আসল বাড়ি। বাবা নাজমুল হক একসময় প্রবাসে ছিলেন। একমাত্র বড় বোন নাজিফা নাওলা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

নওরিন কথা বলে কম। মায়াভরা চোখে কখনো মা, কখনো প্রশিক্ষকের দিকে তাকায়, মাঝেমধ্যে হাসে। একফাঁকে অল্প কথায় সে জানায়, “আমি খুব খুশি। নাচ চালিয়ে যাব, তবে সবার আগে পড়াশোনা।”

মঞ্চে যখন নওরিন এক পায়ে নাচে, এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যায়, মায়ের বড় ভয় করে—যদি ছিটকে পড়ে, যদি কোনো অঘটন ঘটে। কিন্তু এখনো কোনো অঘটন তাকে স্পর্শ করেনি। অদম্য ইচ্ছা আর স্বপ্ন দেখার সাহস যেন পুরো মঞ্চটাই নওরিনের নিয়ন্ত্রণে এনে দিয়েছে।