সরকারের নীতিগত দ্বৈততা: স্বাস্থ্য বনাম বিনিয়োগ

বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি (BEZA) সম্প্রতি ফিলিপ মোরিস বাংলাদেশ লিমিটেডকে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে একটি নিকোটিন পাউচ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল অনুমোদিত এই প্রকল্পের ঘোষিত বিনিয়োগ প্রায় ৫.৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে ম্যানুফ্যাকচারার, ইম্পোর্টার, সাপ্লায়ার ও এক্সপোর্টার হিসেবে নিবন্ধন করেছে।

অনুমোদনপত্র অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৫৩৬.৩ ইউনিট নিকোটিন পাউচ, যেখানে কাজ করবে মাত্র ৬৩ জন কর্মী, যার মধ্যে ৩ জন বিদেশি নাগরিক। প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১.৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তবে এই অনুমোদনকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি “জনস্বাস্থ্যের জন্য এক আত্মঘাতী পদক্ষেপ” যা সরকারের ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০ লক্ষ্য ও বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন- এর সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

নিকোটিন পাউচ একটি তামাকবিহীন কিন্তু উচ্চমাত্রার নিকোটিনযুক্ত পণ্য। এটি ছোট পাউচ আকারে তৈরি হয়, যা ব্যবহারকারীরা গাম ও ঠোঁটের মাঝখানে রাখে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিকোটিন রক্তে শোষিত হয়ে যায়, ফলে ব্যবহারকারী দ্রুত নেশাগ্রস্ত হয়।

একটি সাধারণ সিগারেটে যেখানে থাকে প্রায় ১-২ মিলিগ্রাম নিকোটিন, সেখানে একেকটি নিকোটিন পাউচে থাকে ৮-১২ মিলিগ্রাম বা তারও বেশি। অর্থাৎ, এটি সিগারেটের তুলনায় চার থেকে ছয় গুণ বেশি আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার নিকোটিন রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ, স্ট্রোক, মানসিক উদ্বেগ, ঘুমের ব্যাঘাত এবং প্রজনন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ২০২৪ সালে ইউরোপে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ মিলিগ্রাম নিকোটিনযুক্ত পাউচের ব্যবহার রক্তে নিকোটিনের মাত্রা দ্বিগুণ করে দেয় সিগারেটের তুলনায়, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

প্রকল্প অনুমোদনের সময় BEZA জানিয়েছে, এটি একটি “দেশীয় বাজারমুখী (Domestic Oriented)” উদ্যোগ। অর্থাৎ, উৎপাদিত পণ্য সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের বাজারেই বিক্রি হবে। অর্থাৎ, এই পণ্য দেশের তরুণ ও কিশোর জনগোষ্ঠীকেই সরাসরি টার্গেট করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৩৫% প্রাপ্তবয়স্ক এবং ২০% কিশোর-কিশোরী কোনো না কোনোভাবে তামাক বা নিকোটিন আসক্তিতে ভুগছে। এখন যদি নতুন এই পণ্য বাজারে আসে, তবে এই আসক্তির পরিসর আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

অন্যদিকে, সরকারেরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্প্রতি এক যৌথ ঘোষণায় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ও তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। এমন সময়ে তামাক কোম্পানিকে নতুন নিকোটিন পণ্য উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া, বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, “নীতি ও আইনের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত।”

২০০১ সালের আপিল বিভাগ (সিভিল আপিল নং ২০৪-২০৫/২০০১)- এর রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেশে তামাকজাত দ্রব্যের নতুন কোম্পানি অনুমোদন করা যাবে না এবং বিদ্যমান কোম্পানিগুলোকে ধীরে ধীরে বিকল্প পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। অথচ BEZA- র এই অনুমোদন রায়ের চেতনাকে সম্পূর্ণ অমান্য করছে।

এছাড়া বাংলাদেশ ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)- এর Framework Convention on Tobacco Control (FCTC)- এর সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে নতুন নিকোটিন বা তামাকজাত পণ্য বাজারে প্রবেশে বাধা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করে বাংলাদেশ কার্যত এই আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করেছে।

বিশ্বব্যাপী ফিলিপ মোরিস, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (BAT) ও সুইডিশ ম্যাচের মতো কোম্পানিগুলো ধূমপানের বিকল্প হিসেবে নিকোটিন পাউচকে প্রচার করছে। যুক্তরাষ্ট্রে “ZYN” নামের পণ্যটি ২০২১ সালের পর ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে।

এই জনপ্রিয়তা নিয়ে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও নরওয়ে নীতিগত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স এমনকি ২০২৬ সালের এপ্রিল থেকে নিকোটিন পাউচ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে- যেখানে নিকোটিন আসক্তির প্রভাব নিয়ে এখনও পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, সেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য খোলা দরজা করে দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগের নামে।

BEZA-এর তথ্যানুসারে, পুরো প্রকল্পে মাত্র ৬৩ জন স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অর্থাৎ, কয়েক ডজন চাকরির বিনিময়ে কোটি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ- যার খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবে ইতোমধ্যেই নিকোটিনভিত্তিক বিকল্প পণ্য নিষিদ্ধ করার সুপারিশ রয়েছে। সেখানে BEZA- র এই অনুমোদন সরকারের নিজস্ব নীতি ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

সরকারের উচিত হবে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা এবং জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকারে রাখা। বিনিয়োগ তখনই ইতিবাচক, যখন তা জনগণের স্বাস্থ্য, জীবনমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

আমরা যেন কোনো বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার বিনিময়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিকোটিনের দাসে পরিণত না করি।

ধন্যবাদান্তে,

কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক
সদস্য
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে গঠিত
খুলনা বিভাগীয় টাস্কফোর্স কমিটি।