দেশের তৈরি পোশাক খাতে পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি প্রতিযোগী দেশগুলোর স্বার্থে দেশি-বিদেশি একটি চক্র বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) তিন শ্রমিককে ‘নির্যাতন করে হত্যা’ করা হয়েছে—এমন একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অডিও ও ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়ে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। ফলে ইপিজেড এলাকায় অন্তত আটটি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
তবে শিল্প পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ভিন্ন চিত্র। চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, “কথিত নিহত শ্রমিকরা জীবিত আছেন। ভিডিওটি সম্পূর্ণ সাজানো। কাফনের কাপড় সরিয়ে আবার ঢেকে দেওয়া হচ্ছে—পুরোটাই নাটকীয়ভাবে তৈরি।”
গত ১৬ অক্টোবর এই গুজবের জেরে চট্টগ্রাম ইপিজেডের শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ তাদের সাতটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন এই কারখানাগুলোতে। এক সপ্তাহ পর গতকাল প্রতিষ্ঠানটি আবার উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দেয়।
শিল্প পুলিশের তথ্য বলছে, সংঘর্ষের দিন বহিরাগত কয়েকজন ব্যক্তি সংস্কারকাজের নাম করে ইপিজেড এলাকায় প্রবেশ করে। পরে তারা শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে হামলা ও ভাঙচুরে প্ররোচিত করে। তদন্তে দেখা গেছে, ভাইরাল ভিডিওটি আসলে আগের বছরের একটি ক্লিপ, যা সম্পাদনা করে আবার ছড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “সুপার কমপ্লায়ান্স কারখানাগুলো আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে কাজ করছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা যেন বাংলাদেশের প্রতি আস্থা হারায়, সেই উদ্দেশ্যেই এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে।”
তিনি জানান, চট্টগ্রামে ৪৬৪টি পোশাক কারখানায় প্রায় আট লাখ শ্রমিক কাজ করেন। ইপিজেডসহ পুরো অঞ্চলে মোট শ্রমিকসংখ্যা ১১ লাখের বেশি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক সংকট কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ আবারও রফতানিতে গতি পেয়েছে। এই সময়ে প্রতিযোগী দেশগুলো, বিশেষত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ বাজার দখলের জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
আরেকটি বিষয়ও সামনে এসেছে। ইপিজেডের কিছু শ্রমিক জানিয়েছেন, প্যাসিফিক গ্রুপ সম্প্রতি তাদের ঝুট কাপড় (ফ্যাব্রিক বর্জ্য) নিজেরা পুনর্ব্যবহার শুরু করেছে। আগে এটি বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি হতো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি প্রভাবশালী মহল শ্রমিকদের উসকানি দিচ্ছে বলে অভিযোग উঠেছে।
শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, গত এক বছরে বেতন-ভাতা ছাড়াও তুচ্ছ ঘটনা ও গুজবকে কেন্দ্র করে একশটির বেশি সংঘাত তারা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বর্তমানে ইপিজেড ও আশপাশের শিল্পাঞ্চলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
পোশাক খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত। এ খাতের ওপর প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য নির্ভরশীল। বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজবভিত্তিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে তথ্যনির্ভর সচেতনতা জরুরি। শিল্পাঞ্চলে ডিজিটাল মনিটরিং, দ্রুত প্রতিক্রিয়া টিম, শ্রমিকদের মিডিয়া প্রশিক্ষণ এবং গুজব প্রতিরোধ সেল গঠন এখন সময়ের দাবি।