লেখক: কাজী মোহাম্মদ হাসিবুল হক
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ, বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ হিসেবে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, চরম আবহাওয়া এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন সাইক্লোন, বন্যা ও তীব্র তাপপ্রবাহ। এসব প্রভাবের ফলে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো বাহকবাহিত রোগ, জলবাহিত সংক্রমণ, অপুষ্টি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার হার বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী এসব ঝুঁকির প্রধান ভুক্তভোগী।
বাংলাদেশের আইনি ও নীতিগত কাঠামো জলবায়ু-সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৯ সালে গৃহীত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (BCCSAP) জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলোর মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়সমূহ যেমন রোগ নিয়ন্ত্রণ, জরুরি সেবা প্রদান ব্যবস্থা এবং জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থার জন্য নির্দেশিকা প্রদান করে, যা পরোক্ষভাবে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া, ২০২২ সালের জনস্বাস্থ্য আইন পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যাতে বাহক নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ পানীয় জল এবং রোগ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ প্যারিস চুক্তির মতো একাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তির স্বাক্ষরকারী, যা দেশের গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDCs) টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু-সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে। সেনদাই দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কাঠামো দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়, যা বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বাংলাদেশে জলবায়ু সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করছে, যার মধ্যে রয়েছে পূর্বাভাস ব্যবস্থা, বাহক নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন।
বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপও জলবায়ু-সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন আদালতের রায় পরিবেশগত স্বাস্থ্য নীতিগুলোকে প্রভাবিত করেছে, যেমন বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা। একাডেমিক ও নীতিগত গবেষণাও জলবায়ু-স্বাস্থ্য কৌশল নির্ধারণে অবদান রাখছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন কেন্দ্র (ICCCAD) এবং বাংলাদেশ উন্নত গবেষণা কেন্দ্র (BCAS) এর মতো প্রতিষ্ঠান জলবায়ু অভিযোজন ও জনস্বাস্থ্য সহনশীলতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে, জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। উপযুক্ত আইনি ও নীতিগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক স্বাস্থ্যপ্রভাব হ্রাস করতে পারে এবং নাগরিকদের জন্য একটি সুস্থ ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে।