পৃথিবীর বুকে মানুষের অন্যান্য সমস্ত প্রাণীর সাথে একাত্ম হয়ে সুন্দর পরিবেশে বেঁচে থাকা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিকভাবে বজায় রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের উদ্দেশ্যেই পালন করা হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭২ সালে প্রথম স্টকহোমে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে এই দিবসের সূচনা হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম দিবসটি উদযাপন করা হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর ৫ জুন পালন করা হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারন করা হয়েছে “Beat Plastic Pollution “ বাংলায় ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনি সময়’। এই প্রতিপাদ্য নির্ধারনের লক্ষ্য হল বাস্তুতন্ত্র, বন্যপ্রাণী এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্লাস্টিক দূষণ একটি মারাত্মক সংকটে পরিণত হয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন গভীরতম সমুদ্র, দূরবর্তী পর্বতশৃঙ্গ এবং এমনকি মানবদেহের অভ্যন্তরেও পাওয়া যাচ্ছে।
ইউএনইপি এর অনুসারে, ১৯৫০ সালে প্লাস্টিক উৎপাদন ছিল ২০ লক্ষ টন। যা আজ বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে ৪৩০ মিলিয়ন টনেরও বেশি। এসকল প্লাস্টিকের একটি বড় অংশ একবার ব্যবহারযোগ্য। ব্যবহার শেষে এগুলো জলাশয়, নদী এবং সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। ২০২৫ সালে প্লাস্টিকের উপর নির্ভরতা কমিয়ে, টেকসই বিকল্প গ্রহণ এবং দায়িত্বশীল উৎপাদন ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতি বছর, UNEP একটি ভিন্ন দেশকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য দায়িত্ব দেয় এবং একটি পরিবেশগত মূল সমস্যা তুলে ধরে। ২০২৫ সালে, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজক দেশ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উদ্ভাবনের জন্য দেশটি ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। পাশাপাশি উন্নতমানের পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা, খুচরা বিক্রেতাদের প্লাস্টিক বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটি ইতিমধ্যেই টেকসই অগ্রগতি অর্জন করেছে। এবারের পরিবেশ দিবসে তাদের লক্ষ্য হচ্ছে দক্ষ, প্রযুক্তি-চালিত সমাধানগুলিকে তুলে ধরা এবং ক্ষতিকারক প্লাস্টিক ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার জন্য বিশ্বব্যাপী সহযোগিতাকে অনুপ্রাণিত করা।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিডসের গবেষনা অনুসারে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে প্রতিদিন আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তার মধ্যে ২৫% সরাসরি পরিবেশে দূষক হিসেবে যোগ হচ্ছে। এসব পচনরোধী প্লাস্টিক বর্জ্য ১০% পুড়িয়ে ধ্বংস করা হলেও বাকি ৯০% বেশি পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। সহজে এবং কম দামে হাতের কাছে পাওয়া যায় বলে প্লাষ্টিক পণ্যের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রায় প্রত্যেকের বাড়ীতে কিছু না কিছু প্লাষ্টিকের আসবার পাওয়া যাবে। বদনা থেকে শুরু করে আলমারী, সোফা, চামচ, প্লেট কি নেই। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, চাল, ডাল, মশলা, বিস্কুট, দিয়াশলাই এমনকি রান্না করা খাবারের মোড়কেও এখন প্লাষ্টিকের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের বড় উৎস একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। প্লাষ্টিক এবং পলিথিনের ক্ষতি বিষয়ে আলোচনা করলে সব মিলিয়ে এগুলো একধরনের ভয়ংকর দ্রব্য।
প্লাষ্টিক এবং প্লাস্টিকজাত পণ্য শুধু আমাদের পরিবেশকেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে না মানব স্বাস্থ্যকে ফেলছে মারাত্মক ঝুকির মুখে। ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় সুইজারল্যান্ডের গবেষকরা দেখিয়েছেন, প্লাস্টিক তৈরিতে ১০ হাজারের বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৪০০টি মানুষের শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রমাগত নিয়ন্ত্রনহীন ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে প্লাস্টিক দূষণ এখন সারা বিশ্বের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। কয়েক দশক ধরে, প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে এটি এখন অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয়। পানি এবং খাবারের সাথে আমাদের শরীরে মিশে যাচ্ছে প্লাষ্টিক।
পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম হলেও, এটি সমাধানযোগ্য। যার কিছু সুস্পষ্ট সমাধানও রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উৎপাদকদের উপর দিতে হবে। পাশাপাশি নাগরিকদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। রাষ্ট্রিয়ভাবে প্লাস্টিকের বিকল্প দিতে হবে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। প্লাষ্টিক দূষন কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে এবং যথাযথ বাজার তদারকিও নেই। আমাদের আইনে বলা আছে, ১৪টি পণ্যে পলিথিন প্যাকেট দেয়া যাবে না। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ দিকে নজর দিতে হবে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং পুনঃব্যাবহারে উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে । সে পরিকল্পনা অনুসারে কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ জানানোর জন্য‘৩৩৩ এবং ৩৩৪’ দুটি হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। এখানে প্লাস্টিক দূষন সংক্রান্ত অভিযোগের নিস্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। আর্ন্তজাতিকভাবে যে দেশগুলো প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুসরন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রাণী, ভৌত উপাদান সব কিছু ভালো রাখার জন্যই পরিবেশ আইন। কিন্তু এ আইনটির বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্য নয়। বিদ্যমান পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজন অনুসারে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপন করে সেখানে প্লাষ্টিক এবং অন্যান্য দূষনের দায়ে অভিযুক্তদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
-সৈয়দা অনন্যা রহমান, উন্নয়ন কর্মী