অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। একইভাবে সরকারের কিছু কার্যক্রমে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটিও। বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদে দুজন উপদেষ্টার নিয়োগের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি তারা। এ নিয়ে প্রকাশ্যেই সরকারের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। একইভাবে জাতীয় নাগরিক কমিটিও সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, তাদের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে কি না। বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের বক্তব্য ও ব্যাখ্যায় ভিন্নতা রয়েছে। তবে সবার বক্তব্যে যে বিষয়টি এসেছে সেটি হলো, রাষ্ট্র সংস্কারে তাঁরা একটি ‘প্রেশার গ্রুপ’ (চাপ সৃষ্টিকারী শক্তি) হিসেবে কাজ করতে চান। জনস্বার্থের বিষয়গুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তাঁরা ‘চাপে’ রাখতে চান; যাতে সরকার ভুল পথে না যায়। পাশাপাশি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাও ধরে রাখতে চান তাঁরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্যসহ কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সাধারণ মানুষ পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছে না। এটিসহ কিছু ব্যাপারে সরকারের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার মতামত না নিয়ে গত রোববার নতুন করে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হলো। যাঁদের মধ্যে সেখ বশির উদ্দিন ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করেন তাঁরা। আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থকদের উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলতে পারে। সরকারকে এসব বিষয়ে চাপে রাখা জরুরি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় শিক্ষার্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এটি এখন সংগঠনে রূপ নিয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। প্রায় অভিন্ন লক্ষ্য সামনে রেখে সমাজের ভিন্ন অংশের সঙ্গে কাজ করছে এই দুই সংগঠন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাজ শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক আর নাগরিক কমিটির কাজ পেশাজীবীকেন্দ্রিক।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদচ্যুত করার বিষয়ে কিছুদিন আগে জোরালো দাবি তুলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। দাবি পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময়ও বেঁধে দিয়েছিল তারা। এ বিষয়ে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ কেন নিচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দুই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেকে।
সমালোচনা ও কিছু সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, বিষয়টি এমন নয় জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি সরকারে থাকায় অনেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সরকারের অংশ বলে মনে করছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যক্রমকে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের তৎপরতা বলে সন্দেহ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি দুটি স্বতন্ত্র সত্তা, কোনোভাবেই তারা সরকারের অংশ নয়। এই পার্থক্যরেখাটা পরিষ্কার করতে চাইছেন তাঁরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নই তাদের সব কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য। এ বিষয়ে সংগঠনের সক্রিয় একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্ধভাবে সরকারকে সমর্থন করলে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে জনগণের কাছে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। তাই সরকারের সবকিছুতে আমরা অন্ধ সমর্থন দেব না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দ্বন্দ্ব না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এর কারণ অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার মতামত নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সরকার তথ্য পরিষ্কারভাবে ‘শেয়ার’ (আদান-প্রদান) করছে না, যা সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করছে।