(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
সুন্দরবনের অনতিদূরের এই গ্রামে বাঘ বিধবা শব্দটি সুপরিচিত হলেও কুমির বিধবা শব্দের সাথে তেমন কেউ পরিচিত নয়। বাঘের আক্রমণে নিহতদের স্ত্রীদের কে বাঘ বিধবা নামে অভিহিত করা হয়। পক্ষান্তরে কুমিরের আক্রমণে হতদের ক্ষেত্রে কুমির বিধবা শব্দ ব্যবহারে স্থানীয় সাংবাদিকদের তেমন একটা দেখা যায়না। অথচ সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও এই গ্রামেই দুই-চার ঘর রয়েছে যেখানে এমন বিধবারা যাদের স্বামী কুমিরের আক্রমণে মারা গিয়েছে। বোধহয় সুন্দরবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের তুলনায় কুমিরের তেমন আকর্ষণ জনমানসে নেই। তাই কুমির বিধবা শব্দের প্রচলন নাই।
যাহোক এই গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মৃত ছমির গাজীর ছেলে ফারুক গাজী আজ দুপুর পর্যন্তও জীবিত ছিল। ছমির গাজী চার সন্তানের মধ্যে ফারুক গাজীই বেঁচে ছিল। বাকীরা ছোটবেলায়ই মারা যায় নানা রোগ-শোকে। ছমির গাজী এই এলাকার আদি বাসিন্দা না। নদী ভাঙ্গনে জমি ঘর চলে যাওয়ায় এখানে এসে বসত গেড়েছেন। তিনি গত হয়েছেন বছর দশক আগে। ফারুক গাজীর কুমিরের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত লাশটি উঠানে একটি ছাটাইয়ের উপর রাখা। চেহারা ঠিক আছে, তবে গলায় এবং ডান বাম হাতে কুমিরের দাঁতের দাগের গভীর ক্ষত রয়েছে। লাশটি ঘিরে ছোট ঝটলা। কেউ কেউ কাঁদছে। মৃত ফারুক গাজীর বড় ছেলে আলেফ গাজী। বয়স ১১ কি ১২। হালকা গোঁফের রেখা রয়েছে মুখে। তাকে অন্যরা শক্ত থাকতে বলছে। তার চোখে পানি। কিন্তু কেমন যেন শান্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর অল্প বয়সেই ছেলেরা কেমন যেন পুরুষ হয়ে ঊঠে। ফারুক গাজীর মেয়েটি কান্নাকাটি করছে বাবার জন্য। আলেফ তার বোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আবার তার কাকা ও অন্যদের খবর দিচ্ছে। এলাকার চেয়ারম্যান, এন জি ও কর্মী, থানার লোক এদের প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছে।
ফারূক গাজী এই সময়ে বনে যেতেন না। এটা নিষেধাজ্ঞার সময়। কিন্তু অভাব আইন মানে না। এদের জমা বলতে কিছুই থাকেনা। সামান্য কয়েক দিনের খাবার আর সামান্য টাকা জমা বলতে এই থাকে। তাও শেষ হয়ে গেছে ৩/৪ দিন আগে। তাই ফারুক গাজী আরও দুই-তিন জনসহ মধু সংগ্রহের জন্য নদী সাঁতরে পার হয়ে যায় জঙ্গলে। কিছুটা মধু সংগ্রহও করে। প্রহরীদের তাড়া খেয়ে নদী সাঁতরে ফেরার সময় কুমিরের আক্রমণের শিকার হন ফারুক। প্রায় বেঁচেই যাচ্ছিলেন লড়াই করে। কিন্তু, সকাল থেকে অভুক্ত শরীরটা আর পারলো না। কুমিরে পানির গভীরে টেনে নিয়ে যায়। সহযাত্রীরা তীরে উঠে লাঠিসোটা, নৌকা নিয়ে এদিক সেদিক খুঁজে। কিছুক্ষণ পর লাশ পাওয়া যায়।
ফারুক গাজীর মা ছেলের লাশের পাশে বসে আছে। চোখে দেখেন না, তাই ছেলের লাশ ধরে বোঝার চেষ্টা করছে লাশটি অক্ষত আছে কিনা। পাশের বাড়ির মালেকের বৌকে জিজ্ঞেস করছে- ঐ মালেকের মা আমার ছাওয়ালের লাশটা কি পুরা আছে না অর্ধেক? মালেকের মা বলে, পুরাই আছে। ভাইজানের শুধু হাতে দাগ আছে মনে কুমিররে মারতে গিয়ে দাগ হইছে।
একথা শুনে বৃদ্ধা সামান্য খুশি হয়ে উঠেন। বলতে থাকেন, আমার পোলার শক্তি আছিল পালোয়ানের মত। দেখগা গাঙ্গে কুমিরের লাশ ভাইস্যা উডে কিনা? ঐ গ্রামের করিমের পুলারে কুমিরে ধরছিল, হের লাশ অর্ধেকও পাওয়া যায়নি। এরপরই ছেলের বৌকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, এই মাইয়াডা আমার পোলারে শেষ করছে। জঙ্গলে যাওয়ার আগে ভাত চাইছিল। ঘরে চাল আছিলনা কইয়া বৌ ভাত দিলে না। ভাত আছিল না তো পাশের বাড়ির তে চাইয়া আনতি। ভাত খাইয়া গেলে দুইন্যার কোনো কুমিরের সাধ্য আছিলেনা আমার পোলার কোনো ক্ষতি করার। এই কথা বইলা বুড়ি আবার বিলাপ জূড়ে দিল। কিশোর আলেফ গাজী এই কথায় অপমানবোধ করল। বুড়ি চুপ কর বলে সে ধমক মারল।
ফারুক গাজীর স্ত্রী ফাতেমা বার বার অজ্ঞান হচ্ছিল। জ্ঞান ফিরে আসলে বলছিল, মানুষডারে শেষ খাওয়া কয়ডা ভাত খাওয়াইতে পারলামনা। প্রতিবেশী মালেকের বৌ দৌড়ে ফাতেমার কাছে গিয়া চিৎকার করে বলতে লাগল, তুই না আমার বইন হস। চাল নাই, ভাত নাই- আমারে কইলি না ক্যান? কয়বার চাওইয়া যায় আফা? –উত্তর দিল ফারুক গাজীর স্ত্রী ফাতেমা। যে কয়বার লাগে ঐ কয়বার চাইতি, তাও সোয়ামিরে না খাওয়াইয়া বাদারে ছাড়লি ক্যানরে বইন?- কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল মালেকের বৌ। মৃত ফারুক গাজীর ছেলে যে কিনা ভালো ফুটবল, ক্রিকেট খেলে; যে কিনা ফাইভ পাশ করেছে সে এসব কথায় খুব লজ্জা পায়। তার বাবা ভাতের অভাবে শক্তিহীন হয়ে কুমিরের হাতে মারা গেছে এটা প্রতিবেশীরা জানছে এটাই আলেফ গাজির অস্বস্তির কারণ। এবার সে তার মা এবং দাদীকে জোরে শোরে ধমক দেয়।
উপস্থিত চেয়ারম্যান তার পরিষদের তহবিল হতে পাঁচ হাজার টাকা দিবেন বলেছেন। বনবিভাগের প্রতিনিধি এবং চেয়ারম্যান সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ তাড়াতাড়ি দেবার ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা এক এনজিও কর্মী ফারুকের ছেলের নিকট থেকে কি কি তথ্য যেন টুকে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াতে পারে এরকম একজন ফারুক গাজীর পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে যায়। মৃত ফারুক গাজীর ছেলে আলেফ গাজীর খেলাধূলা- স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। আগের চেয়ে সে অনেক গম্ভীর। পাড়াত চাচাদের সাথে বনে যায়। আরও টুকটাক কায়িক শ্রম দেয় পরিবারের খরচ চালানোর জন্য।
৭ বছর পর…
ছমির গাজীর নাতি, ফারুক গাজীর ছেলে ছয় ফিট লম্বা আলেফ গাজী জীবিত এবং রক্তাক্ত। তার সাথে আছে প্রতিবেশী মালেক গাজীসহ আরও দুই-তিন জন। একটা মৃত কুমিরকে ভ্যান থেকে নামানো হচ্ছে। আলেফ গাজীর দাদী বুড়ি চিৎকার শুরু করে দিল, আমার আলেফের কি হইছে বলে। সাথে সাথে মালেকের বৌ বলল, আলেফ না কুমিরের কি হইছে জিগাও? আলেফের মা অর্থাৎ ফারুক গাজীর স্ত্রী হতবাক হয়ে যায়। ছেলের ক্ষত-বিক্ষত হাত-পা ন্যাকড়া দিয়ে বাধঁতে বাঁধতে জিজ্ঞেস করে, কি হইছে বাপ? এত রক্ত ক্যান তোর হাতে? আর এই মরা কুমির ক্যান আনছস? ও মালেক ভাই কিছু কও? ফারুক গাজীর অন্ধ-বৃদ্ধ মাকে উদ্দেশ্য করে মালেক গাজী বলে, বুড়ি তোমার নাতি আজ কুমির মাইরছে। তোমার পোলারে যে কুমিরে মারছে তারে মারছে। বুড়ি কান্না শুরু করে। বলতে থাকে, পোলারে কি আর পাওন যাইব, কয়ডা ভাতের অভাবে আমার পোলাডা কুমিরের পেডে গেল। থানা ও বনবিভাগের লোকজন এল তাদের বাড়িতে। তারা ফারুক গাজীর কুমিরের হাতে মৃত্যুর কাহিনী জানে।
আলেফ এবং মালেক গাজীকে জিজ্ঞাসা করে এবং আলেফের ক্ষতের অবস্থা দেখে তারা পরিস্থিতি আন্দাজ জানতে পারল। মালেক গাজী জানায়, অন্যদিনের মত আলেফ গাজী, মালেক গাজী সহ আরও দুইজন নিষেধাজ্ঞার সময় বনে মধু, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহে যায়। তাড়া খেয়ে সাঁতরে ফেরার পথে প্রায় তীরের কাছে আলেফ গাজী কুমিরের আক্রমণে পড়ে। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। দাঁতে ধরে থাকা দা হাতে নিয়ে কুমিরের মাথায় ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। এক পর্যায়ে মালেক গাজী ও আরও দুই সহযাত্রী তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কুমিরটা তখনও তার পা কামড়ে ধরে রাখে। এই অবস্থাতেই সে ডাঙ্গায় ঊঠে। অসহনীয় যন্ত্রণা ও প্রচণ্ড ক্রোধে আর আট-দশেক কোপ দেয় কুমিরের মাথায়। কুমিরটাকে না মেরে কি পার যেত না, জবাবে আলেফ বলে, সাহেব কুমিরে আর বাঘে যহন ধরে তহন বাপের নামও মনে থাকেনা। অত চিন্তা করার সময় কই? আলেফ গাজীর সাথে মালেক গাজীও থানা ও বনবিভাগের লোকজনের সাথে। কুমিরটিকেও ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আলেফের মা ও দাদী কান্না করতে থাকে। অফিসার বলে আলেফ নিজের জীবন বাঁচাতে কুমিরকে আঘাত করেছে মর্মে সে রিপোর্টে উল্লেখ করবে।
সবাই চলে যাবার পর মৃত ফারুক গাজীর মা অন্ধ বুড়ি প্রতিবেশী মালেক গাজী বৌকে জিজ্ঞাস করে, ও মালেকের বৌ কুমিরডা কি বড় আছিল? মালেকের বৌ হ্যাঁ –সূচক জবাব দিলে বৃদ্ধা নিজে নিজে বলতে থাকেন, তাইলে এইডাই আমার পোলারে মারছে। আর বড় কুমির ছাড়া কি ছোডো কোনো কুমির আমার পোলারে মারতে পারত? বড় কুমিরও পারত না যদি হেদিন পোলাডা ভাত খাইয়া জঙ্গলে যাতে পারত। সব দোষ ঐ মাইয়াডার। আমার পোলারে ভাত দিল না। এই বলে বৃদ্ধা আবার কাঁদতে লাগলেন। আলেফের মা মাটির ব্যাংক ভাংছেন, টাকা গুনছেন। মালেকের বৌয়ের সাথে ধার-দেনা নিয়ে কথা বলছেন। আলেফরে ছুটাতে হবে। কুমিরেরা হ্যাঁ করে আছে।
—————————————————-
মোঃ ইউসুপ আলী,জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার,খুলনা।
লেখক ও গবেষক