এন্ট্রি ফি চারগুণ বৃদ্ধির প্রতিবাদে শনিবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরনের কনটেইনার ও পণ্যবাহী যানবাহনের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন অপারেটররা। এতে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে পণ্য খালাস ও পরিবহনে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক জরুরি সভার পর চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা পণ্য পরিবহন সমিতি, চট্টগ্রাম ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এবং প্রাইম মুভার অ্যান্ড ফ্ল্যাটবেড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জানিয়েছে, প্রধান স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ ছাড়াই ‘জোরপূর্বক’ নতুন ফি আরোপ করা হয়েছে, যা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
হঠাৎ চারগুণ বেড়ে গেল ফি
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বিভাগ ১৩ অক্টোবর একটি অফিস আদেশ (নং ২২৩/২৫) জারি করে প্রতিটি ভারী যানবাহনের জন্য নতুন এন্ট্রি ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করে। এতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত হয়ে মোট ফি দাঁড়িয়েছে ২৩০ টাকা। এর আগে এই ফি ছিল মাত্র ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ রাতারাতি ফি বেড়েছে প্রায় চারগুণ।
পরিবহন সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, তারা বন্দরের প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্গো পরিচালনা করেন। এমন বড় ধরনের পরিবর্তনের আগে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কিন্তু কোনো আলোচনা না করেই হঠাৎ এই ফি আরোপ করা হয়েছে।
একটি যৌথ বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, “আমরা আগেও প্রতিবাদ করেছি এবং ফি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের আবেদন উপেক্ষা করেছে।”
কে বহন করবে অতিরিক্ত খরচ?
প্রাইম মুভার অ্যান্ড ফ্ল্যাটবেড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, “এটি কোনো কর্মবিরতি বা ধর্মঘট নয়। পোর্ট কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে প্রতিটি গাড়িতে ১৭৩ টাকা বেশি ফি ধার্য করেছে, কিন্তু স্পষ্ট করেনি এই অতিরিক্ত খরচ কে বহন করবে— মালিক না শ্রমিকরা।”
তিনি জানান, এই অস্পষ্টতার কারণেই ১৫ অক্টোবর থেকে ট্রেইলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফি বৃদ্ধির বিষয়টি শুধু টাকার অঙ্কই নয়, এটি তাদের ব্যবসায়িক টিকে থাকার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
শনিবার থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ
ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে এই সপ্তাহের শুরুতে কিছু সংগঠন ইতোমধ্যেই তাদের যানবাহন বন্দরে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিল। চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, শনিবার সকাল ৬টা থেকে সব ধরনের গাড়ির বন্দরে প্রবেশ ‘অস্থায়ীভাবে স্থগিত’ থাকবে।
পরিবহন সংগঠনগুলোর নেতারা তাদের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোকে এই সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছে, বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের ন্যায্য দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে ‘সাধারণ কার্যক্রম চলছে’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক অবশ্য বলেছেন, বন্দর সাধারণভাবে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, কিছু অভিযোগ এসেছে যে ট্রেইলার মালিকরা কিছু যানবাহনের চলাচল স্থগিত করেছে।
“কিছু প্রভাব পড়েছে, আমরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছি,” বলেন ওমর ফারুক। তবে তিনি এই সংকট সমাধানে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা জানাননি।
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কনটেইনার ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলে পণ্য খালাস, সরবরাহ ও রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে আমদানিকৃত কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও ভোগ্যপণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। একই সঙ্গে রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজে তোলা সম্ভব হবে না, যা দেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে।
সমাধান কোথায়?
পরিবহন সংগঠনগুলোর দাবি, বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান করুক। তারা চান, হয় নতুন ফি প্রত্যাহার করা হোক, নয়তো সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক একটি ফি নির্ধারণ করা হোক।
বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন পরিবহন নেতারা। তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষ যদি তাদের দাবির প্রতি ইতিবাচক সাড়া না দেয়, তাহলে এই কর্মসূচি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সংকটের সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে। বিশেষত রপ্তানিমুখী শিল্পখাত এবং আমদানিনির্ভর ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।