বাংলাদেশ শ্রম আইন লঙ্ঘন করায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর এমডিসহ ৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। গত মঙ্গলবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মো. ফারজুন ইসলাম বাদী হয়ে খুলনা বিভাগের শ্রম আদালতে এ মামলা করেন। বিএটিবি’র যে চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলেন, কোম্পানির এমডি মনিশা আব্রাহাম, হেড অপ অপারেশনস জর্জ লুইস মার্সেডো, কোম্পানির সেক্রেটারি ও সিনিয়র লিগ্যাল কাউন্সেল সৈয়দ আফজাল হোসেন এবং প্লান্ট ম্যানেজার (জি.এল.টি.পি) মুকিত আহমেদ চৌধুরী। বিএলএ (ফৌজদারী) মামলা নং ৩৮/২০২৫।
এদিকে কুষ্টিয়ায় শতাধিক বিএটির শ্রমিক টানা ৮ম দিনের মতো অবস্থান ধর্মঘট পালন করছে। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা জানিয়েছে তাদের ২২ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানিতে কর্মরত মৌসুমী শ্রমিক/কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় তথ্যসহ চাকরিকালীন এক নিয়োগপত্র প্রদান করা হয় না। কর্মরত মৌসুমী শ্রমিক/কর্মচারীদের প্রতিবছর বছর নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। শ্রমিকদের স্থায়ী করা হয় না। কারখানায় একই সেকশনে একই প্রকৃতির কাজে একজন শ্রমিককে স্থায়ী শ্রমিক (কর্তৃপক্ষের ভাষায় পারমানেন্ট এমপ্লয়ী) হিসেবে কাজ করাচ্ছেন আরেকজন জন শ্রমিককে ২০১২/২০১৩ এর পরবর্তী সময় হতে বছর বছর কারখানা কর্তৃপক্ষ মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে কাজ করাচ্ছেন। স্থায়ী পদে নিয়োগকৃত মৌসুমী শ্রমিকদের যোগদানের তারিখ হতে স্থায়ী করা হয় নাই। মৌসুমী কারখানায় শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বৎসরে নিয়োগকৃত শ্রমিকদেরকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়নি। ২০২৪ সালের মৌসুমে পূর্ববর্তী মৌসুমের ১১ জন মৌসুমী শ্রমিককে চাকুরিতে না নিয়ে ধারা-৪(১২) লঙ্ঘন করেছেন। অংশগ্রহণ তহবিলের ব্যবহার সঠিকভাবে করা হয়নি। কারখানায় কর্মরত মৌসুমী শ্রমিকদের ২০১২ সাল হতে অদ্যবদি মুনাফার অংশ প্রদান করা হয়নি।
উপরোক্ত ঘটনা প্রবাহ দেখা যায় যে, কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরী (জিএলটি) চৌড়হাস, বিসিক, কুষ্টিয়া সদর, কুষ্টিয়া এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত সত্যতা পাওয়া যায়। পূর্বে আইন বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ বরাবর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয়, কুষ্টিয়া, প্রধান কার্যালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক বারংবার পত্র প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আইন বাস্তবায়ন না করে বারংবার পত্র প্রদান করে দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন করেছে।
ফলে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬; বিধিমালাঃ বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এর ধারা-৫, বিধি-১৯, ধারা-৪ (১২), ধারা-২৪২ লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে।
মামলার নথিতে বলা হয়েছে, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের পর মামলার বাদী ও অত্র দপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মো. মুনছুর বিল্লাল বিএটি’র কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরী (জি.এল. টি.) নামের কারখানাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে ঘটনার সত্যতা পান। এ অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় সভা গত ০৩ জুলাই ২০২৪ তারিখ অত্র দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ০৯ জুলাই, ২০২৪ তারিখ কারখানা কর্তৃপক্ষ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিষয়টির আইনগত প্রশ্ন তুলে সৈয়দ আফজাল হোসেন, সিনিয়র লিগাল কাউন্সেল এবং কোম্পানি সেক্রেটারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি পত্র অত্র দপ্তরে প্রেরণ করেন এবং বিষয়টি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে হাজির হননি।
বিএটি কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরী (জিএলটি) এর কারখানায় কর্মরত ১২৮ জন এবং ২০২৪ সালে নিয়োগ প্রদান না করা ১১ জন এবং চাকুরীচ্যুত ৫ জন এর পক্ষে ২২ দফা দাবী সম্বলিত একটি অভিযোগ কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া হয়। সেটার ভিত্তিতে একটি ত্রিপক্ষীয় সভায় জেলা প্রশাসক তদন্ত করার নির্দেশনা প্রদান করেন। পরে নির্দেশনা মোতাবেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, কুষ্টিয়া এবং আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, কুষ্টিয়ার সমন্বয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া কার্যালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। উক্ত তদন্ত কমিটি ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তদন্ত প্রতিবেদন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করেন। তারই আলোকে পরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) সভাপতিত্বে একটি সভা আয়োজন করা হয়।
সভায় সর্বসম্মত ২টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১. ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, কুষ্টিয়া জিএলটি কারখানায় মৌসুমী শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কর্তৃক প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ বরাবর উপমহাপরিদর্শক কার্যালয়, কুষ্টিয়া অবিলম্বে প্রেরণ করবেন এবং ২। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, কুষ্টিয়া জিএলটি তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রাপ্তির ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্তের বিষয়সমূহ আইনানুগভাবে প্রতিপালন পূর্বক উপমহাপরিদর্শক কার্যালয়, কুষ্টিয়াকে অবহিত করবেন।
বিএটিবি’র গ্রীন লীফ থ্রেশিং প্ল্যান্টের প্লান্ট ম্যানেজার মুহাম্মদ মাহাবুবুল আলম খান চিঠিতে জানিয়ে দেন ১০ কর্মদিবসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং আগামী মৌসুম শুরু পর্যন্ত সময় আবেদন করেন। পরবর্তীতে রাজু বড়ুয়া, শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ), উপ মহাপরিদর্শক এর কার্যালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, কুষ্টিয়া উক্ত বিষয়ে তাগিদপত্র প্রদান করেন। পরে মুহাম্মদ মাহাবুবুল আলম খান পত্রের মাধ্যমে একটি ব্যাখা প্রদান করেন। কিন্তু দৃশ্যমান কোন কিছু বাস্তবায়ন করেননি। গত ০৪ মার্চ, ২০২৫ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিএটিবি কুষ্টিয়ার কাছে চিঠিতে ব্যাখা চায়। উক্ত চিঠির জবাবে সৈয়দ আফজাল হোসেনের মাধ্যমে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের মতামত পেশ করেন।