ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কোন ফল এড়িয়ে চলবেন? উচ্চ জিআই ফলের তালিকা ও স্বাস্থ্যকর বিকল্প

ঢাকা, ১৭ আগস্ট ২০২৫ — ফল আমাদের খাদ্যতালিকার একটি অপরিহার্য অংশ। এগুলো ফাইবার, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে, ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সব ফল সমানভাবে উপযোগী নয়। উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন ফল রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে, যা ডায়াবেটিকদের জন্য ক্ষতিকর। তবে, এর অর্থ এই নয় যে ডায়াবেটিক রোগীদের ফল খাওয়া বন্ধ করতে হবে। বরং, সঠিক ফল নির্বাচন এবং পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারেন। এই প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব কোন ফলগুলো এড়িয়ে চলা উচিত এবং কোন ফলগুলো নিরাপদ ও উপকারী।

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) কী?

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) হলো একটি সংখ্যা (০-১০০) যা নির্দেশ করে কোনো খাবার কত দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। জিআই ৫৫-এর নিচে থাকলে তা নিম্ন, ৫৬-৬৯ হলে মাঝারি এবং ৭০-এর বেশি হলে উচ্চ বলে বিবেচিত হয়। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য নিম্ন জিআই ফল বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো রক্তের শর্করা ধীরে ধীরে বাড়ায় এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। এছাড়া, ফাইবার, প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবারের সাথে ফল খাওয়া গ্লুকোজ স্পাইক কমাতে সহায়ক।

ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এড়িয়ে চলার ফল

আম

আমে প্রাকৃতিক চিনি (গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ) প্রচুর পরিমাণে থাকে। একটি মাঝারি আকারের আমে (প্রায় ২০০ গ্রাম) ৪০-৪৫ গ্রাম চিনি থাকতে পারে। এর জিআই ৫১-৬০, যা মাঝারি থেকে উচ্চ।আমে ফাইবারের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, ফলে শরীরের পক্ষে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়। ফলস্বরূপ, আম খাওয়ার পর রক্তের শর্করা দ্রুত বাড়তে পারে।

ভালো বিকল্প: ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি বা রাস্পবেরির মতো বেরি জাতীয় ফল। ১০০ গ্রাম স্ট্রবেরিতে মাত্র ৪.৯ গ্রাম চিনি থাকে এবং জিআই ৪০-এর নিচে। এগুলো ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি-তে সমৃদ্ধ, যা ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় সহায়ক। বেরিগুলো দীর্ঘক্ষণ ভরবোধ (স্যাচিয়েশন) প্রদান করে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে পারে।

পাকা কলা

পাকা কলায় স্টার্চ চিনিতে রূপান্তরিত হয়, যার ফলে এর জিআই ৬০-এর উপরে চলে যায়।একটি মাঝারি আকারের পাকা কলায় (প্রায় ১২০ গ্রাম) ১৮-২০ গ্রাম চিনি থাকতে পারে। কলায় প্রোটিন ও চর্বি কম থাকায় একা খেলে গ্লুকোজ স্পাইক নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। উচ্চ কার্বোহাইড্রেটের কারণে এটি কার্ব নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ভালো বিকল্প: পেয়ারা, যাতে ১০০ গ্রামে মাত্র ৫ গ্রাম চিনি এবং জিআই ৩০-৪০। পেয়ারা ফাইবার এবং ভিটামিন সি-তে সমৃদ্ধ, যা রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং হজমশক্তি উন্নত করে।

চিকু

চিকুতে চিনির পরিমাণ অত্যধিক (১০০ গ্রামে প্রায় ২০ গ্রাম) এবং জিআই ৬৫-৭০। এর ফাইবার কম, ফলে রক্তের শর্করা দ্রুত বাড়ে। একা খেলে চিকু ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ভালো বিকল্প: আপেল (ছালসহ), যার জিআই ৩৬-৩৯ এবং ফাইবার বেশি। আপেলে পেকটিন নামক ফাইবার রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

আঙুর

আঙুরে ১০০ গ্রামে ১৬-১৮ গ্রাম চিনি থাকে এবং জিআই ৫০-৫৯ এর পাতলা খোসা এবং কম ফাইবারের কারণে গ্লুকোজ দ্রুত শোষিত হয়, যা রক্তের শর্করা বাড়ায়।

ভালো বিকল্প: আনার (পমগ্র্যানেট), যার জিআই ৫৩ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।আনার প্রদাহ কমায় এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় উপকারী।

আনারস

আনারসের জিআই ৬৬-৯৪, যা উচ্চ।১০০ গ্রাম আনারসে প্রায় ১০ গ্রাম চিনি থাকে। যদিও এতে কিছু ফাইবার আছে, তবুও বেশি পরিমাণে খেলে রক্তের শর্করা দ্রুত বাড়তে পারে।

ভালো বিকল্প: পেঁপে, যার জিআই ৬০ এবং ফাইবার বেশি।পেঁপে হজমশক্তি উন্নত করে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়।

ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ফল খাওয়ার পরামর্শ

বিশেষজ্ঞরা ডায়াবেটিক রোগীদের ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পরামর্শ দেন:

পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ: একবারে অল্প পরিমাণ ফল খান (যেমন, ১০০-১৫০ গ্রাম)।

প্রোটিন বা চর্বির সাথে খাওয়া: ফলের সাথে বাদাম, দই বা পনির খেলে গ্লুকোজ শোষণ ধীর হয়।

খাবারের সময়: ফল খালি পেটে না খেয়ে প্রধান খাবারের সাথে বা স্ন্যাক হিসেবে খান।

চিকিত্সকের পরামর্শ: ডায়াবেটিসের ধরন এবং শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. আনিসা রহমান বলেন, “ডায়াবেটিক রোগীদের ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকার প্রয়োজন নেই। তবে, জিআই এবং গ্লাইসেমিক লোড (জিএল) বিবেচনা করে ফল বেছে নেওয়া উচিত। নিম্ন জিআই ফল এবং ফাইবারযুক্ত খাবার রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।” তিনি আরও জানান, ফলের রসের পরিবর্তে পুরো ফল খাওয়া উচিত, কারণ রসে ফাইবার থাকে না এবং এটি দ্রুত গ্লুকোজ বাড়ায়।

সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে, ওয়েবএমডি, হেলথলাইন, ডায়াবেটিস কানাডা, আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য।

Share This News