২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাসন পরিবর্তনের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হলেও অতীতের নানা চ্যালেঞ্জ ও ক্ষত এখনও গভীরভাবে বিদ্যমান।
প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংস রাজনৈতিক ঘটনা। কয়েক সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও বিক্ষোভের ঢেউ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত রাজনৈতিক রূপ নেয়। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে শত শত মানুষ নিহত হন, আহত হন হাজারো মানুষ। সহিংসতার ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে, ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
এরপর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘প্রধান উপদেষ্টা’ হিসেবে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় । এই নতুন সরকারের অধীনে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকটাই প্রশমিত হয় এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়। তবে প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রভাব এখনো কাটেনি।
আগের সরকারের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ ছিল—নির্বিচারে হত্যা, গুম, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, বিদেশে থাকা সমালোচকদের হয়রানি, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা ও সেন্সরশিপ, শ্রমিক আন্দোলনে দমন-পীড়ন, শ্রমিক নেতাদের ওপর হামলা, এমনকি শিশুশ্রমের ভয়াবহ বিস্তার। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় ছিল—এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তি পাওয়া।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দায়মুক্তি সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আগের সরকারের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকার জাতিসংঘের সহযোগিতায় জবাবদিহি নিশ্চিতের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং সাধারণ আদালতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত গুরুতর লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি আন্তর্জাতিক মহলে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে স্পষ্ট সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে—মানবাধিকার রক্ষায় শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন শক্তিশালী আইনপ্রয়োগ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, এবং ভুক্তভোগীদের জন্য কার্যকর ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। অন্যথায়, অতীতের ক্ষত ভবিষ্যতের জন্য নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।