বাংলাদেশের আইসিইউ সংকট: অচল ইউনিট ও কর্মী ঘাটতিতে মৃত্যুঝুঁকিতে রোগীরা

১৯ আগস্ট, ২০২৫ – রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা আবুল হাশেম (৭৫) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) রেফার করা হয়। তার ছেলে, গণমাধ্যমকর্মী সাইফুল জুয়েল বলেন, “চিকিৎসকরা বলেছিলেন, ছয় ঘণ্টার মধ্যে বাবাকে আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু ঢামেকে গিয়ে দেখি, আইসিইউ শয্যার জন্য দীর্ঘ সিরিয়াল। আবেদন জমা দিয়েও বাবাকে বাঁচাতে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করি। ২৫ দিন পর ঢামেকে আইসিইউর ব্যবস্থা হলেও ততক্ষণে বাবাকে আর নিয়ে যেতে পারিনি। ওই দিনই তিনি মারা যান।”
এই দুঃখজনক ঘটনা শুধু সাইফুল জুয়েলের নয়, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউর বাইরে প্রতিদিন শত শত স্বজনের এমন আক্ষেপ চোখে পড়ে। মুমূর্ষু রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়। ঢামেকে প্রতিদিন একটি আইসিইউ শয্যার জন্য প্রায় ৭০ জন রোগী অপেক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সবসময় রোগীতে ভর্তি থাকে। বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউর ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় স্বজনরা সরকারি হাসপাতালে একটি শয্যা পাওয়ার আশায় থাকেন। কিন্তু এই সংকটের মধ্যে দেশের ১২টি হাসপাতালের আইসিইউ অচল অবস্থায় পড়ে আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শ্বাসকষ্টের রোগী বেড়ে যাওয়ায় কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের আওতায় ৪৮টি জেলায় ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের জন্য ৫১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ হিসেবে একটি আইসিইউ ইউনিট স্থাপনে গড়ে খরচ হয়েছে ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। কিন্তু এখন ১২টি হাসপাতালে আইসিইউ অচল থাকায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই হাসপাতালগুলো হলো: সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল (ভিক্টোরিয়া), শেরপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল, বাগেরহাট জেলা সদর হাসপাতাল, মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতাল এবং মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “জনবলের অভাবে এসব আইসিইউ চালু করা যাচ্ছে না। করোনার সময় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। এখন অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। ডাক্তার, নার্স, টেকনোলজিস্ট—সব পর্যায়ে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়াধীন। আমরা দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।”
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “আমাদের ১৪০টি আইসিইউ শয্যা ও ৪০টি এইচডিইউ শয্যা রয়েছে। এর দ্বিগুণ থাকলে রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হতো না। প্রতিদিন ৬০-৭০টি আইসিইউ শয্যার আবেদন আসে। আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ৪,০০০ রোগী ভর্তি থাকে। অনেকেরই আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। ঢাকার বাইরে থেকে রেফার করা রোগী, টারশিয়ারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও রোগী আসে। আমরা দিনে মাত্র ৩-৪ জন রোগীকে আইসিইউতে নিতে পারি।”
বিএসএমএমইউ’র এনেস্থেসিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তফা কামাল বলেন, “প্রতিদিন একটি আইসিইউ শয্যার জন্য ৬৫-৭০ জনের অনুরোধ আসে। এর মধ্যে ৪০ জন আবেদন জমা দেন, আর ২৫-৩০টি অনুরোধ অনলাইনসহ বিভিন্নভাবে আসে। আমাদের কেবিন ব্লকে ২১টি আইসিইউ শয্যা, ১০টি এইচডিইউ এবং সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালে ২০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে, যার মধ্যে চারটিতে ডায়ালাইসিসের সুবিধা আছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪২টি জেলার ৭৪টি সরকারি হাসপাতালে মোট ১,৩৭২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে, যার ৭৫৮টি (৫৫%) ঢাকার ২২টি সরকারি হাসপাতালে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ সহযোগী অধ্যাপক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, “আমাদের ৩৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। প্রতিদিন ৩-৫টি আবেদন আসে। ফাঁকা থাকলে একটি শয্যা বরাদ্দ দেওয়া যায়, কখনো দেওয়া যায় না। ডেঙ্গুর মৌসুমে চাপ বেশি থাকে। এখানকার বেশিরভাগ রোগীর বেসরকারি আইসিইউর খরচ বহনের সামর্থ্য নেই। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বা চিকিৎসা বিনামূল্যে, তবে স্টোরে ওষুধ না থাকলে তা কিনতে হয়।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. সেহাব উদ্দিন বলেন, “আমাদের ২০টি আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। এইচডিইউ দ্রুত চালুর চেষ্টা করছি। গত সপ্তাহে আমি যোগদান করেছি। প্রতিদিন ৪-৫টি আইসিইউ শয্যার আবেদন আসে।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, জনবলের সংকট দ্রুত সমাধান না হলে অচল আইসিইউগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে, এবং দুর্বল রোগীরা ঝুঁকিতে থাকবে। সাইফুল জুয়েলের মতো পরিবারের শোকের মধ্যে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপের দাবি জোরালো হচ্ছে।

Share This News